তরুণসমাজকে বিভ্রান্ত করবেন না

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

রোগ শয্যায় শুয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র পাঠ করে মনে হয়, বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষকে একটা ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের বেশ কয়েকজন ইন্টেলেকচুয়ালকে বশ করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি ঢাকার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য এবং সাবেক সচিব আকবর আলি খান কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি বিএনপি-জামায়াতের ভারতবিদ্বেষকেই বেশ সফিস্টিকেটেড ওয়েতে প্রচার শুরু করেছেন। আকবর আলি খানকে আমি চিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব তরুণ সিএসপি অফিসার আগরতলায় জমায়েত হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্য অফিসার যেখানে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তখন আকবর আলি খানের মতামত ছিল কিছুটা হতাশামণ্ডিত। তিনি মার্ক্সবাদ বিষয়েও একটি বই লিখেছেন। সেটি পড়েই মনে হয়েছিল তিনি একজন বিভ্রান্ত ইন্টেলেকচুয়াল। তারপর ইয়াজউদ্দিনের গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বিভিন্ন সময় যেসব মন্তব্য করেছেন তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির সহায়ক হয়নি।

সম্প্রতি সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স আয়োজিত ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ভারতের কাছে আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকার প্রয়োজন নেই এবং তা উচিতও নয়। তারপর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস টেনে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর কোনো দেশই একে অপরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ নয়। সে কথা ঠিক নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমেরিকা টাকা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে ইউরোপ, বিশেষ করে ব্রিটেনকে রক্ষা করেছিল। ব্রিটেন সে জন্য আমেরিকার কাছে চিরকৃতজ্ঞ এবং লেবার বা টোরি যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তারা আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলে। ব্রিটেন তো আমেরিকার অনেক দুষ্কর্মের সঙ্গী। ব্রিটেনের লেবার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ব্রিটেনের ৯০ শতাংশ লোকের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে কুখ্যাত ইরাক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশও দিয়েছিল।

ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, ফ্রান্সের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য তিনি আমেরিকার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপের রক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে তার মতভেদ আছে। পৃথিবীতে সভরেনটির অর্থ এখন সীমিত হয়ে গেছে। কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, পৃথিবীতে সভরেনটি আছে মাত্র দুটি দেশের। দেশ দুটি হলো আমেরিকা ও চীন। আর দেশগুলো হয় প্রত্যক্ষভাবে আমেরিকা অথবা পরোক্ষভাবে চীনের লেজুড় দেশ। আমেরিকার সাহায্য ছাড়া ব্রিটেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। তেমনই রাশিয়ার সাহায্য ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা পাবে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের মিত্রতা ও সহযোগিতা আমাদের একান্ত দরকার।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য অতুলনীয়। ২০ হাজার ভারতীয় সৈনিক এই যুদ্ধে আত্মদান করেছেন। স্বাধীন অথচ দরিদ্র বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেশ কিছুকাল টিকিয়ে রেখেছে ভারত। ভারতে সরকার পরিবর্তন হয়ে সাম্প্রদায়িক বিজেপির সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপির জয়ে বাংলাদেশে বিএনপি নর্তন করেছিল। আওয়ামী লীগ করেনি। কিন্তু দেখা গেল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বন্ধুত্ব ও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন শেখ হাসিনার দিকে, অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকারের দিকে। আজও তা কমবেশি অটুট আছে। কিছুকাল আগে আমেরিকা পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। কিন্তু অপরাপর বন্ধুদের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ভারতের কাছে আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকতে হবে গণতান্ত্রিক সহযোগিতার জন্য। চীনে এই গণতন্ত্র নেই। ভারতে যদি গণতন্ত্র টিকে থাকে তা বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। বাংলাদেশের উচিত চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা গ্রহণ করা রাজনৈতিক শর্তমুক্ত হয়ে।

চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে বিস্তৃত হলে চীন বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকে ঠেলবে। চীন তালেবানি আফগানিস্তানের সমর্থক। সুতরাং বাংলাদেশের উচিত প্রথমেই চীনের অর্থনৈতিক অভিযান সম্পর্কে সতর্ক থাকা। আকবর আলি খান আরেকটি কথা বলেছেন, যা আরো মারাত্মক। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয়েছে। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। চিন্তার কারণ হলো গণতন্ত্র নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা বিশ্বাস করি উদারনৈতিক গণতন্ত্রে। এই গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন হলেই চলবে না। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল যে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, তাকে ধ্বংস করে গেছে জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়া পর্যন্ত সরকারগুলো। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন, কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এখনো সুপ্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চর্চা চলছে এখনো দেশে। আকবর আলি খান কোথায় দেখলেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেশে সুপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে?

আমাদের নাগরিক কালচার এখন মুম্বাইয়া কালচার। আচার-আচরণে আমরা বাঙালি কি না তা ঠাওর করা যায় না। একদিকে মধ্যযুগীয় মৌলবাদী কালচার দেশে ফিরে এসেছে, অন্যদিকে মুম্বাইয়া কালচার। আকবর আলি খান জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় কোথায় দেখলেন? বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয়েছে, আকবর আলি খান এটা কোথায় পেলেন?

বিএনপি আর জামায়াত যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় সেটাকেও কি স্বাধীন মতামত বলে শ্রদ্ধা জানাতে হবে? আকবর আলি খান মনে করেন, বাংলাদেশের সমস্যা গণতন্ত্র।

অবশ্যই আওয়ামী লীগ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চর্চা করছে না। তারা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র অনুসরণ করছে। এটা ভালো হতো যদি তারা এই কর্তৃত্ববাদকে দুর্নীতি দমনে প্রয়োগ করত। আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি দমন করতে পারলে আমরা বাংলাদেশের মতো দেশে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের উপকারিতা বুঝতে পারতাম। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র দ্বারাই দ্রুত উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নামে হলেও পাহারা দিচ্ছে। শেখ হাসিনা কর্তৃত্ববাদী না হলে বহু আগেই দেশ তালেবান হয়ে যেত। এই শাসনে সেই বিভীষিকা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। আকবর আলি খান সে কথা ভেবে দেখেছেন কি?

বর্তমান সরকার যদি দুর্নীতি দমন করতে পারত, তাহলে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র স্বাভাবিকভাবেই চালু থাকত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলা হয়েছিল, তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে কিভাবে? বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী অর্থনীতি গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সামরিক জান্তা সেই অর্থনীতি ধ্বংস করে দেশে পচনশীল ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রচলন করেছে। দেশে তাই আজ এত দুর্নীতি ও লুটপাট। আওয়ামী লীগের বহু মন্ত্রী ও এমপি তাতে জড়িয়ে পড়েছেন। শেখ হাসিনা এখন একা। দেশ পরিচালনায় তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা জোগাতে হবে। তরুণসমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবার অনুপ্রাণিত করতে হবে। আকবর আলি খান সাহেব বুদ্ধিজীবী সেজে এই তরুণসমাজকে বিভ্রান্ত করবেন না। এটাই তাঁর কাছে আমার প্রার্থনা।

লন্ডন, সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

শেয়ার করুন