কোভিড-পূর্ব সময়ের কথা। এক সকালে ৯টা ২৫ মিনিটে ক্লাসে এসেছি। সাধারণত আমার ক্লাস ছাত্রছাত্রীতে ঠাসা থাকে। কিন্তু সেদিন অর্ধেক ছাত্রছাত্রীও নেই। বিষয়টি বিসদৃশ লাগল। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কী। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আজ হলগুলোতে ঝামেলা আছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি আঁচ করতে পারলাম।
বললাম, আজ ছাত্রলীগের মিছিল আছে বোধহয়। ওরা মাথা নিচু করল। এটি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। বিএনপির আমলে ছাত্রদল আর আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রলীগ। ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণালি অধ্যায় এখন ধূসর ইতিহাস হয়ে গেছে। এসব সংগঠনের তরুণ তুর্কিদের এখন ছাত্র কল্যাণমূলক কোনো কর্মসূচি নেই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তো সংস্পর্শই নেই। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ভীতি প্রদর্শন এদের প্রধান কাজ। সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অভিন্ন চিত্র।
যে কোনো উপলক্ষ্যে সরকারি দলের প্রতাপশালী ছাত্র সংগঠনের বড় মিছিল বের করতে হবে। ওরা জানে ওদের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী মিছিলে আসবে না। তাই প্রথমে হল থেকে বেরোনোর কলাপসিবল গেট বন্ধ করতে গার্ডদের বাধ্য করে। ক্লাস পরীক্ষার দোহাই দিয়ে কোনো ক্ষমা পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে প্রক্টোরিয়াল বডি এর প্রতিবিধানে কখনো সরব হয় না।
শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। নানামুখী সংকটের মুখে এখন শিক্ষার্থীরা। বছর কয়েক আগে আমাদের অফিস সহকারী ছেলেটি আমাকে জানাল, প্রথমবর্ষের তিনটি ছাত্রী আছে, তাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্র নাকি এ ধরনের শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করছে। সুযোগ এলে তাদের আর্থিক সহায়তা দেবে। আমাকে বলল, তালিকা তৈরি নাকি শেষ। এখন আমি যদি ওদের আবেদনপত্রে সুপারিশ করে দেই। এর কারণ আমি তখন বিভাগের ছাত্রকল্যাণ বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক। আবার এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের পরিচালকও ছিলাম।
ছাত্রী তিনজন ওদের আবেদনপত্র নিয়ে এলো। ওদের বসতে বলে খোঁজখবর করলাম। ওদের কারও বাড়ি থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। এদের একজন একটু ভালো অবস্থায় আছে একটি টিউশনি পেয়েছে বলে। জানতে পারলাম দুবেলা খাওয়া জুটছে না ওদের। বন্ধুদের সামান্য সহযোগিতায় টিকে আছে। উচ্চশিক্ষার জন্য অদম্য আগ্রহ এবং মেধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এখন দারুণ হতাশ ওরা। সংকোচ নিয়েই বলল, বেশ কয়েকটি কোর্সে শিক্ষকরা ক্লাস নিতে তেমন আসেন না। ক্লাসে বিঘ্ন ঘটছে প্রায়ই। এতে সেশনজট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। এমনিতেই মাটি কামড়ে পড়ে আছে, তার মধ্যে যদি সেশনজট বৃদ্ধি পায়, তবে ওদের টিকে থাকা দায় হবে। দুজন তো জানিয়ে দিল ওদের আর পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
এর কয়েক বছর আগে দেখা একটি ছাত্রের কথা আমার মনে পড়ে গেল। ছিপছিপে গড়নের সাদামাটা চেহারার ছেলে। গায়ের রং শ্যামলা। কথা বলার ঢংয়ে একটা বিনীত ভাব। বলল-স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব। তখন আমি ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্বে। সেই সূত্রে মাঝে-মধ্যে বিচিত্র সব বিষয়ে পরামর্শ চাইতে আসে ছাত্ররা। আমাদের অফিসে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা মনোবিজ্ঞানী আছেন। তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানা জটিল ও বিচিত্র মনো-সমস্যা রয়েছে। ভালো লাগে যখন দেখি, মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে থেকে অনেক ছেলেমেয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসছে। আরও একটি কাজ তখন চলছিল এই কেন্দ্রে। তালিকা তৈরি হচ্ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। যে অভিভাবকরা বাড়িতে পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটর চান এবং যে ছাত্ররা টিউশনি পেতে আগ্রহী, আমরা তাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
এ দুই প্রয়োজনেই ছাত্রছাত্রীরা তখন বেশি আসছিল কেন্দ্রে। অবশ্য এসবের জন্য আমার কাছে সরাসরি আসার প্রয়োজন পড়ে না। তাই এ ছেলেটি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কারণ চট করে বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওকে সামনের চেয়ারটিতে বসতে বললাম। সামান্য দ্বিধা নিয়েই ও সব কথা খুলে বলল। ধরে নিই ওর নাম মাসুদ। কলা অনুষদের একটি বিভাগে পড়ছে। বলল ওর নিজের কথা। সাতক্ষীরায় বাড়ি ওর। বরাবর ভালো ফলাফল করেছে। মেধার প্রমাণ রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাসুদ। তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন স্কুলের শিক্ষক কবির স্যার এবং এলাকার বড় ভাই শেখ ইয়াসিন। তারা আর্থিক সহায়তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। বাবা ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ছয়জনের সংসার নির্বাহে হিমশিম খান। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তার জন্য বিলাসিতা। মাসুদ তিনটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। চেষ্টা করে বাবাকে পাঁচ-সাতশ টাকা পাঠাতে। আর প্রতিদিন কর গুনে কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবে। চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরবে। ওর কাছে এক একটা দিন এক একটি বছরের মতো।
ছেলেটির হিসাব থেকে দেখলাম, এর আগের তিন বছরে রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী ঝামেলায় মাঝে মাঝে ক্লাস পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটেছে। সামান্য সেশনজটও তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে নানা কারণে মাসুদের আর্থিক সংকট বেড়েছে। এখন সেশনজটের আশঙ্কা ওকে বিমর্ষ করে। সে সময় ওকে খুব শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল ভিসি পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের একটি অংশের আন্দোলন। বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাস নিলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অনেকেই নিচ্ছিলেন না। কষ্টের সঙ্গে মাসুদ জানাল, যখন অধিকাংশ কোর্সের ক্লাস শেষের দিকে তখন আন্দোলকারী শিক্ষক নেতা মাত্র দুটি ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষকদের ক্লাস-ধর্মঘট ও ব্যক্তিগত অসাধুতায় ক্লাস না নেওয়ার কারণে ওদের হিসাবে ছয় মাস থেকে একবছর সেশনজটের ফাঁদে পড়ে যাবে। মাসুদের পক্ষে টিকে থাকার সংগ্রামে এ এক কঠিন সংকট।
মাসুদ প্রশ্ন করে-স্যার, এ থেকে বেরোনোর উপায় কী? শিক্ষকরা কি আমাদের কথা একবারও ভাববেন না? আমি বিব্রত। কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললাম-মাসুদ, এর উত্তর আমার জানা নেই। পরক্ষণেই মনে হলো এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়তো! সত্যি কি উত্তরটি আমার জানা নেই?
শেষ এপিসোডটি এ ঘটনার কিছুটা পরেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে ভর্তি প্রক্রিয়া। হঠাৎ স্থগিত করা হলো ভর্তি কার্যক্রম। পরিচিত দু-একজন অভিভাবকের ফোনে বিষয়টি আমি জানতে পারি। টিভি স্ক্রলেও দেখতে পেলাম। প্রকৃত বিষয়টি জানার চেষ্টা করলাম। জানলাম বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ব্যাংকে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তাদের ভাষায় ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে বিভাগের উন্নয়ন ফি নামে যে অর্থ নেওয়া হয়, তা বন্ধ করতে হবে।
পাঠককে একটু খোলাসা করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাকুল্যে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। এর বাইরে প্রতি বিভাগ উন্নয়ন ফি নামে একটি অর্থ গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট যেহেতু সীমিত, তাই এ ফি থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে ছাত্রকল্যাণ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির ব্যয় নির্বাহ করা হয়।
কিন্তু ফি নির্ধারণে বিভাগগুলোর ওপর কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার সাধারণ ও অভিজাত দুধরনের বিভাগ আছে। কারণ অনেক বিভাগ দুই থেকে তিন হাজার টাকা উন্নয়ন ফি নিলেও কোনো কোনো বিভাগ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে (জানি না এখন আরও বেড়েছে কিনা)! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশের পরিবার দরিদ্র। এরা ধারদেনা করে পাঁচ ছয় হাজার টাকা নিয়ে এসে ভর্তি হতে গিয়ে উন্নয়ন ফির লম্বা অঙ্ক দেখে হোঁচট খায়।
অনেক বছর আগের কথা, যখন কলা অনুষদভুক্ত অধিকাংশ বিভাগ ২ হাজার টাকা উন্নয়ন ফি নিচ্ছিল, তখন ব্যবসাসংশ্লিষ্ট একটি বিভাগ উন্নয়ন ফি নির্ধারণ করেছিল ১০ হাজার টাকা। প্রথমবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম চলার সময় উদ্ভ্রান্তের মতো আমার কাছে ছুটে এলেন একজন অভিভাবক তার মেয়ে নিয়ে। পরিচয় দিলেন গ্রাম সম্পর্কে তিনি আমাদের আত্মীয় হন। চাষবাস করে কোনো রকমে সংসার নির্বাহ করেন। তার মেয়েটি ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় টিকে গেছে। তিনি কয়েক বস্তা ধান আর আলু বিক্রি করে ছয় হাজার টাকা নিয়ে এসেছেন মেয়েকে ভর্তি করাতে।
বিভাগের অফিস জানিয়ে দিল, ১০ হাজার টাকা উন্নয়ন ফি না দিলে ফরম দেওয়া হবে না। সেদিনই ভর্তির শেষ দিন। ভদ্রলোক জানালেন তার আর ক্ষমতা নেই। মেয়েকে ভর্তি করানোর আশা ছেড়ে দিতে হবে। মেয়েটির চোখ ছলছল করছিল। আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগের দু-একজন পরিচিত শিক্ষককে ফোন করে বুঝতে পারলাম উন্নয়ন ফির কোনো মাফ পাওয়া যাবে না। পরে আমি বাসায় ফোন করে আমার স্ত্রীর বদান্যতায় মেয়েটির ভর্তি সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এখন নাকি এ ধরনের অভিজাত বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে। এসব বিচারেই ছাত্ররা উন্নয়ন ফি বন্ধের জন্য অবরোধ তৈরি করেছে। এতে অবশ্য দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেক অভিভাবক বিপদে পড়েছেন।
এভাবে ছাত্রদের অবরোধ করা কতটা যৌক্তিক হয়েছে তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের সতর্ক করে দিয়ে নোটিশ জারি করেছে। আমরা অবশ্য এমন ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার মতো অবরোধকে যৌক্তিক মনে করি না। কিন্তু এটিও বোধগম্য নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা একাডেমিক কাউন্সিল কেন সব বিভাগের জন্য একটি সহনীয় অভিন্ন অঙ্কের উন্নয়ন ফি ধার্য করবে না? যেখানে সাধারণ নাগরিকের শিক্ষার প্রশ্ন জড়িত, সেখানে বিভাগগুলোর অবাধ স্বাধীনতা থাকার কথা নয়। আর বাম ছাত্রদের বলছি, তাদের তো বছর ধরেই সুযোগ ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে অভিন্ন এবং যৌক্তিক উন্নয়ন ফি নেওয়ার জন্য দাবি উত্থাপন করা। বিভিন্ন বিভাগের স্বেচ্ছাধীন উন্নয়ন ফির লাগাম টেনে ধরার জন্য সরব হওয়া। ভর্তি প্রক্রিয়া চলার সময় এভাবে জিম্মিদশা সৃষ্টি করা কাম্য হতে পারে না।
এসব খণ্ডচিত্র বলে দেয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কত বিচিত্র সংকট নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য ত্রাতার ভূমিকায় কে বা কারা থাকবেন, এখন এটি সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন। মারমা সম্প্রদায় তাদের নববর্ষের উৎসব সাংগ্রাইয়ে পানি ছিটানোর আয়োজন করে। তরুণীরা তরুণদের প্রতি পানি ছুড়ে মারে আর তরুণরা তরুণীদের দিকে। এভাবে তারা পুরোনো বছরের সব ক্লেদ-ময়লা ধুয়ে একটি স্বচ্ছ শুভ্র নতুন বছর কামনা করে। আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে, আসন্ন নতুন বছরে আমাদের ছাত্র, শিক্ষক ও জাতীয় রাজনীতির এ ধারার কলঙ্ক মুছে যাক বিবেক জাগ্রত করা সূচি শুভ্রতায়। যার যার জায়গা থেকে আমরা যদি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারি, তবে নতুন বছরের ঔজ্জ্বল্য বাড়বে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়