করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বছর দুয়েক ধরে বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট হয়তো পাদপ্রদীপের বাইরে রয়েছে, তবে এই সময়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই সংকট ২০২২ সালে আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চলা দ্বন্দ্ব শরণার্থী সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের সময় ২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। তবে ২০২১ সালে উদ্বাস্তু সংকটের কারণে ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
জাতিসংঘরে শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দুই কোটি শরণার্থীর মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা আরও বেশি আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ অথবা কোনো উন্নয়নশীল অঞ্চলে। উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের কথা বলা যায়। সীমান্ত লাগোয়া অন্য দেশগুলোর তুলনায় তুর্কিরা সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছে। তুরস্কে ৩৫ লাখের বেশি শরণার্থী রয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ৪৩ জনই শরণার্থী।
এরপর জর্ডানে শরণার্থী রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ। এমনকি ছোট্ট দেশ লেবাননেও রয়েছে ১৫ লাখ। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে বর্তমানে প্রতি ১০০ নাগরিকের মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা ১৩ জনের বেশি।
ইউরোপের মধ্যে জার্মানিতে শরণার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখ বাস্তুহারা মানুষ। জার্মানি বা ফ্রান্সের চেয়ে অনেক আশ্রয়প্রার্থী যায় যুক্তরাজ্যে। এরপরও দেশ দখল করে নেওয়া হচ্ছে বলে ‘ভুল ধারণা’ সেখানে পাকাপোক্ত। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার ভেতর শরণার্থী মাত্র এক-দশমাংশ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া বছরে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ইরানিরা।
চলতি বছর নভেম্বর মাস পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে ২৩ হাজার ৫০০ জন, যা ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এছাড়া, সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার আগে আরও ১৮ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আটকে দিয়েছে ফ্রান্স।
তবে এটি এখনো নিশ্চিত যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছে বহু মানুষ। এদের বেশিরভাগই আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাসিন্দা। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্পেন, ইতালি, মাল্টা, গ্রিস বা সাইপ্রাসে পা রাখতে অন্তত ৮১ হাজার ৬৪৭ জন জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।
গত ২৫ নভেম্বর ফ্রান্স উপকূলে তিন শিশুসহ ২৭ শরণার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাই প্রমাণ করে, কতটা ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছিলেন তারা। খবরটি আরও স্মরণ করিয়ে দেয়, চলতি বছরে এ পর্যন্ত পূর্ব আটলান্টিক বা কুখ্যাত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ২ হাজার ৫৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪২২ শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে ইতালি বা মাল্টা যাওয়ার পথে। মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রোজেক্ট রিপোর্ট বলছে, এই রুটে ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসের তুলনায় ২০২১ সালের একই সময়ে শরণার্থী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। এর পেছনে করোনা সম্পর্কিত বিধিনিষেধ শিথিল করা একটি বড় কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর বাইরে আরও ৯৫৯ জন মারা গেছে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে স্প্যানিশ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের মধ্যকার বিপজ্জনক রুট পাড়ি দিতে গিয়ে। চলতি মাসের শুরুর দিকে সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে তিন শতাধিক শরণার্থী নিয়ে রওয়ানা দিয়েছিল পাঁচটি ডিঙি নৌকা। সেখান থেকে এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এর সঙ্গে তুলনা করা যায় ২০১৫ সালে তুরস্কে উপকূলে ভেসে ওঠা তিন বছর বয়সী সিরিয়ান শরণার্থী আইলান কুর্দির কথা। সমুদ্রতীরে তার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মরদেহের ছবি ব্যথিত করেছিল সারা বিশ্বকে। এরপর শরণার্থী সংকট নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হলেও এখনো সেই সংকট থেকে বের হওয়া যায়নি।
আইলানের মৃত্যুর পরের পাঁচ বছরে আরও ১৭ হাজার মানুষ সমুদ্রপথে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে কতজন শিশু তা নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হয়, প্রতি পাঁচ শরণার্থীর মধ্যে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। অর্থাৎ, আইলানের মৃত্যুর পর একই পরিণতি হয়েছে আরও অন্তত ৩ হাজার ৪০০ শিশুর।
২০২১ সালের নভেম্বর শেষে দেখা যায়, অন্তত ১ লাখ ৯ হাজার ৭২৬ শরণার্থী ইউরোপে পৌঁছাতে পেরেছেন। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা খুব একটা খারাপ নয়। ২০১৫ সালে ইউরোপে ১০ লক্ষাধিক মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের সন্ধান করেছিলেন। তবে এর পরের বছরগুলোতে সেই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করে। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩০০ জন এবং ২০১৭ সালে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ জন শরণার্থী ইউরোপে পৌঁছান। পরের তিন বছরেও ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখা গেছে। ২০১৮ সালের ১ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ জন থেকে ২০২০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৯৫ হাজার ৭০০ জন। তবে ২০২১ সালে সেই প্রবণতা আবারও বাড়তে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনায় স্পষ্ট যে, ২০২২ সালে বিশ্বের শরণার্থী সংকটের চিত্র আরও বদলে যেতে পারে। বিশেষ করে ইরিত্রিয়া এবং ইথিওপিয়ায় সংকট তীব্র হতে পারে। ২০২১ সালের মতো পরের বছরও শরণার্থী সংকটে বড় অবদান থাকতে পারে মিশর, ইরান এবং সিরিয়ার।
ইউএনএইচসিআরের ইন্টারন্যাশনাল প্রোটেকশন প্রধান গিলিয়ান ট্রিগস বলেন, মহামারি সত্ত্বেও যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এতে লাখ লাখ মানুষ যেমন বাস্তুহারা হচ্ছে, তেমনি বহু লোক ঘরে ফিরতে বাধা পাচ্ছে। এ অবস্থায় মানবিক সহায়তা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে জীবন সংকটাপন্ন লোকদের পুনর্বাসনে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
শরণার্থীদের পুনর্বাসনে কাজ করে যাচ্ছে এইএনএইচসিআর। তারা জানিয়েছে, গত বছর বিশ্বজুড়ে ২ কোটি ৭ লাখ শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ৩৫ হাজার জনের পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের এই সংস্থাটির ধারণা, ২০২২ সালে অন্তত ১৪ লাখ শরণার্থীর পুনর্বাসনের প্রয়োজন পড়বে।
সূত্র: আরব নিউজ