সালতামামি : ২০২১ সালে ত্রিমুখী চাপে ছিল দেশের অর্থনীতি

মত ও পথ ডেস্ক

বাংলাদেশের অর্থনীতি

ত্রিমুখী চাপের মুখে পড়েছে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনীতি। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে ভর্তুকি।

এছাড়া বেড়েছে সরকারের সুদ পরিশোধ খাতের ব্যয়। রয়েছে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এসব কারণে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বছরের শুরুতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মহামারি মোকাবিলায় দেশজুড়ে লকডাউনের আঘাত লাগে প্রবৃদ্ধির গতিতে।

যে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও খুব বেশি আশার সঞ্চার হয়নি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও কম ছিল। রেমিট্যান্স খাতেও নেতিবাচক ধারা বইছে। তবে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি ফিরছে। স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসছে আমদানি ও রপ্তানি। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতে বইছে ইতিবাচক ধারা।

কেমন গেল দেশের অর্থনীতি, তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। যে কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে।

ফলে এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্য ও সেবা খাতে। এ বছর মূল্যস্ফীতি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। তবে যে কোনো মূল্যে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটি সম্ভব না হলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার মতে, বিশ্ব অর্থনীতির সবকিছু খুলে দিয়েছে।

বাংলাদেশেও অন্যান্য সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। রপ্তানি আয় কিছুটা বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ও বাজেট বাস্তবায়ন আগের বছরের তুলনায় ভালো হয়েছে। এখন নজর মূল্যস্ফীতির দিকে।

বছরের শেষদিকে দেশের অর্থনীতি সচল রাখা গেলেও করোনার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। উৎপাদন, ভোগ, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যাংক ও আর্থিক খাত, প্রকল্প বাস্তবায়ন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রাস্ফীতির মতো সূচকে যে প্রত্যাশা ছিল তার চেয়ে অর্জন কম হয়েছে।

সরকারি হিসাবে ২০২১ সালে এক কেজি আটায় ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, ময়দায় ৩৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, পাম অয়েলে ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ ও মসুর ডালে বেড়েছে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ হারে দাম বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি মানুষগুলোকে চরম ভোগান্তিতে ফেলছে। পাশাপাশি বেড়েছে পরিবহণ ভাড়া।

এদিকে চলতি বছর মার্চে দেখা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। তা মোকাবিলা করতে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু মহামারিতে ক্ষুদ্র আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্ম হারিয়ে চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা ২২ শতাংশে নিয়ে যায়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে দেখানো হয়, কোভিডের আঘাতে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এই প্রণোদনা বড় শিল্প-কলকারখানায় ব্যাংকগুলো সন্তোষজনকভাবে বিতরণ করলেও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা নানা জটিলতায় গ্রহণ করতে পারেননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে আড়াই মাসে প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন ৩ শতাংশের কম হয়েছে।

এর মধ্যে শিল্প ও সেবা খাতে বাস্তবায়ন ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও সিএমএসএমই খাতে বাস্তবায়ন ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এদিকে কলকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও সেগুলো ১০০ ভাগ সক্ষমতায় চলছে না। শিল্প-কারখানায় নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে খুবই কম। সেজন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কম হয়েছে। চালু শিল্প-কারখানাগুলো টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করছে।

এদিকে বছরের শেষ ৬ মাসে অর্থনীতি ধীরে ধীরে চাঙা হয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাজেট থেকে টাকা খরচ করা হয় ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে ব্যয় হয় ১ লাখ ২৪ হাজার ১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় খরচের পরিমাণ বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা।

এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরায় রাজস্ব খাতেও আদায়ের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। জুলাই-নভেম্বর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এই ঘাটতি মেটাতে এখন সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে ব্যাংকিং খাত থেকে। গত বছর এ সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয় ১২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। অথচ এ বছর সেটি ১৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। ঋণ নেওয়া অপর খাত সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।

যা গত বছর ছিল ১৯ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। এদিকে বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্যতা কমেছে। করোনার কারণে অনেক দেশ আগের মতো ঋণ সহায়তা দিচ্ছে না। কারণ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি দেশ নিজস্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। যে কারণে বৈদেশিক ঋণ কম পাওয়া যাচ্ছে।

জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া পরিমাণ হলো ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও এটি শেষ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে উঠতে পারে এমন আশঙ্কা করছে অর্থ বিভাগ।

অর্থনৈতিক অবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো দেশের আমদানি-রপ্তানি। যদিও করোনা মহামারির আগে থেকেই দেশের আমদানিতে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজমান ছিল। করোনার কারণে দেশে ব্যবসা মন্দা হওয়ায় আমদানিতে ধস নামে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ আসে চীন থেকে। করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে এ আমদানির অনেকাংশ কমে যায়। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে চীন থেকে আমদানি সচল হয়।

বর্তমান আমদানি ব্যয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। গত অক্টোবরে ৭১১ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। এর আগে কখনোই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এত বেশি অর্থ ব্যয় হয়নি। এর আগে সেপ্টেম্বরে ৬৯৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়। আগস্টে আমদানি হয়েছিল ৬৫৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের পণ্য। গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে মোট দুই হাজার ৫৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে।

এদিকে জুলাই থেকে নভেম্বরে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ সময় রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি আয় হয় ১ হাজার ৫৯২ ডলার।

আশার আলো হচ্ছে দেশে এ বছর মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বর্তমানে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২২২৭ ডলার। গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার, যার বর্তমান বাজার মূল্যে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা।

শেয়ার করুন