‘বহু ভঙ্গ বঙ্গ দেশে তবু রঙ্গে ভরা’

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

রাজশক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে একটি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও যে ভাগ্য পরিবর্তন হয়, তা ইতিহাস পাঠেই আগে জেনেছিলাম। কিন্তু তার বাস্তব প্রমাণ পাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে আমি লন্ডনে চলে আসি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সুদীর্ঘ ১৮ বছর দেশে যেতে পারিনি। জিয়াউর রহমান আমার পাসপোর্ট নিয়ে নানারকম খেলা খেলছিলেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার আমাকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রদান করেন। এরশাদের শাসন শেষ হওয়ার সুদীর্ঘ ১৮ বছর পর আমি দেশে যাই। তখন বিএনপির শাসন। সে সময় একটা ব্যাপার বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ঢাকা শহরে ধুতি প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। শাড়িও লুপ্ত হওয়ার পথে। হিন্দু যুবকরাও পাজামা পরছেন এবং হিন্দু মেয়েদেরও কাপড় পরিধান পরিবর্তিত হয়েছে। আগে হিন্দু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলে তারা নমস্কার বলতেন আমাকে। এখন অধিকাংশ বন্ধু দেখা হলেই আসসালামু আলাইকুম বলেন, খোদা হাফেজ বলেন। কোনো কোনো হিন্দু বাড়িতে খেতে গিয়ে তাদের বিসমিল্লাহ বলে খাবার শুরু করতে দেখেছি। তাতে আমি বিস্মিত হই। এটি কী? দেশ এতটা পালটে গেল কীভাবে? লন্ডনে ফিরে আসার পর মুনমুন কর্মকার নামে এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দেখলাম তিনি গরগর করে সূরা ফাতিহা আবৃত্তি করেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সূরা ফাতিহা এত ভালোভাবে কী করে আবৃত্তি করেন? মুনমুন জবাব দিলেন, আমরা তো নিচের ক্লাসে এসব সূরা পড়েছি। বুঝলাম এটি জামায়াতি মৌলানা মতিউর রহমান নিজামীর কাজ। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে আর কিছু না পারেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয়করণের ব্যবস্থা করে গেছেন। পরে আরও কিছু হিন্দু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বুঝলাম, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, আবার শাসক পরিবর্তনের সঙ্গে শাসকদের কালচার তারা গ্রহণ করেছে। এটি সবসময় সব দেশে হয়।

১৯৭৪ সালে কলকাতায় আনন্দবাজার অফিসে গিয়েছিলাম। তখন নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন সন্তোষ কুমার ঘোষ। তার কক্ষে একটা ইজিচেয়ারে বিখ্যাত সাহিত্যিক সিরাজ বসা ছিলেন। তিনি পরিপাটি ধুতি পরা এবং আচার ব্যবহার দেখে আমি মনে করিনি তিনি মুসলমান। তিনি আমাকে দেখে বললেন নমস্কার। কলকাতার রাস্তায় হেঁটে বুঝলাম এখানেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কালচার পরিবর্তন হয়েছে। অতীতেও মুঘল অথবা নবাবি শাসন আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ফার্সিতে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এবং নবাবি আমলের পোশাক পরিধান করতেন। রাজা রামমোহন রায়ের ছবি দেখলেও বোঝা যায় তিনি পাগড়ি পরতেন এবং ফার্সিতে লিখতেন। তখনকার হিন্দু এলিট ক্লাস চমৎকার ফার্সি জানতেন। এ সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মুঘলরা আমাদের ৭শ বছর ধরে ফার্সি শিখিয়েছে। আমাদের তা ভুলতে লেগেছে ১শ বছর।’ বাংলাদেশে মুঘলদের আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিধান হিন্দুদের ভুলতে লেগেছে ৫০ বছর। হিন্দু এলিট ক্লাস দ্রুত ইংরেজি শিখেছে। এবং শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরি-বাকরি সবকিছুতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এটি হিন্দুদের দোষ নয়। ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানরা পিছিয়ে রয়েছে এবং দেশের নেতৃত্ব হারিয়েছে।

এখন আসল কথায় আসি, বাংলাদেশ আগে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, প্রথমদিকে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল ২৫ ভাগ, হিন্দু, বৌদ্ধরা তখন তাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করেননি, ঢাকার রাস্তায় ধুতি-চাদর দেখা যেত এবং রকমারি শাড়িও দেখা যেত। পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকরা হিন্দু-মুসলমান উভয়ের বাঙালিত্ব লুপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। তখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বাঙালিয়ানার উত্তাপ ছিল প্রচণ্ড। মুসলমানরাও নবান্ন এবং শারদীয় উৎসবকে তাদের বলে মনে করতে শুরু করে। বাঙালি মুসলমান এলিট ক্লাস উর্দুর দিকে ঝুঁকেননি, হিন্দুরাও নয়। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রকৃত বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালাভের কয়েক বছরের ভেতরেই বাঙালিয়ানা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেল কেন? বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতাদের দিকে তাকালে টুপি ও দাড়ির বাহার দেখা যাবে। তারা অসাম্প্রদায়িক দল বলে দাবি করেন, কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান শুরু হয় ধর্মীয় সূরা দ্বারা। এটি গোটা পাকিস্তান আমলে ছিল না। তখন বাঙালিত্ব নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তার উচ্চশির দেখিয়েছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাবি করেছেন, বাংলায় আমাদের কথা বলতে দিতে হবে। আমার প্রশ্নটা এখানেই, গোটা পাকিস্তান আমলে, পূর্ব পাকিস্তানে যেখানে বাঙালিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণির বাঙালিকে সংগ্রামে নামতে দেখা গিয়েছিল, আজ তারা স্বেচ্ছায় সেই বাঙালিত্ব ত্যাগ করে কী করে মুম্বাইয়া কালচার গ্রহণ করেছে? আমি বছর দুই আগে ঢাকায় এক বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, দেখে অবাক হলাম যে, এটা ঢাকার কোনো অনুষ্ঠান না মুম্বাই শহরের অনুষ্ঠান? গান-বাজনা যা হচ্ছিল সবই হিন্দি, আধুনিক মুম্বাইয়া কালচার, ড্রেসও তাই। আমার মনে হচ্ছিল আমি মুম্বাইয়ে অবস্থান করছি। ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের পরিচিতি পরিবর্তন করতে পারেননি। ডাণ্ডা মেরেও পারেননি। এখন সেখানে সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। মুম্বাইয়া কালচার অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে এক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। সিনেমায় পরীমনি, মাহিয়া মাহিকে নিয়ে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটল, তা মুম্বাইকে অনুকরণ করার ফল। শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন বাংলাদেশে ধ্বংসের পথে। শিক্ষা সংস্কার ও তার বাঙালি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশের রচনা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ শাসনামলেই। সকলের অগোচরে পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু লেখকের সংখ্যা কমানো হচ্ছে। বাংলা ভাষায় হিন্দুসমাজের দান কম নয়, বরং বেশি। বর্তমানে যেভাবে শিক্ষায় কর্তন নীতি চলছে, তা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে প্রকৃত বাঙালির খোঁজ পাওয়া যাবে না। নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হলে, বাইরের সংস্কৃতি সেখানে এসে আধিপত্য বিস্তার করবেই। মুম্বাইয়া ছবি হলিউডের ছবিকে অনুকরণ করে; ঢাকার ছায়াছবি তা অনুকরণ করে। ঢাকার ছবিতে প্রত্যেকটি মারপিটের দৃশ্য দেখে মনে হবে, আমরা মুম্বাইয়া ছবি দেখছি। যেসব বাঙালি মুসলমান তরুণী তাতে অভিনয় করেন, মুম্বাইয়া ছবির মতো নগ্নতাকে প্রশ্রয় দেন, তারা কিছুদিনের মধ্যে আবার হজ করতে চলে যান মক্কায়। মাহিয়া মাহির বোরকা পরা ছবি দেখলাম সম্প্রতি। শাবানা, শাবনূর এরা সব হিজাব পরা গৃহবধূ হয়ে গেছেন। শাড়ি পরে বাঙালি হতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ আমলে ৫শর বেশি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলোতে নিয়োগের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষক পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে এসব শিক্ষকের পদ জামায়াতিরা দখল করে নেবে। যেমন তারা নিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। বঙ্গবন্ধু প্রকৃত ইসলাম বিস্তারের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন তা হেফাজতিদের কবলে। কী আশ্চর্য, দেশটা স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হেফাজতিরা ১৩ দফা দাবি প্রদান করে এবং দাবি করে দেশে ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠার। দেশ কোন পথে যাচ্ছে বিদেশে বসে ঠিক বুঝতে পারছি না। ইতোমধ্যেই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় তালেবানরা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। খোদা হাফেজকে বলা হয়, আল্লাহ হাফেজ। ৭শ বছর ধরে আমরা খোদা হাফেজ বলেছি। তাহলে এখন আল্লাহ হাফেজ বলছি কেন? ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে পারসিদের দ্বারা। খোদা হাফেজ কথাটি এসেছে পারস্য থেকে। সৌদি আরবের তা সহ্য হয়নি। তারা প্রচার করছে খোদা হাফেজ বলা, যা ইসলামসম্মত নয়। এবং বিএনপির শাসনামলে এ আল্লাহ হাফেজের আবির্ভাব। সৌদি আরব চেয়েছিল ইরানি কালচারকে অপসারণ করে বাংলাদেশে সৌদি কালচারাল প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে। সৌদি বাদশাদের কালচার ইসলামভিত্তিক নয়। ওয়াহাবিজমভিত্তিক। ওয়াহাবিজম ইসলামকে বিকৃত করেছে। কিন্তু সেটাই প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়েছে বাংলাদেশে। এ বিকৃতি থেকে যদি ইসলামকে মুক্ত করা না যায়, বাংলাদেশে সত্যিকার বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না।

দেশ থেকে যা খবর পাই, তা দ্রুত সামাজিক অবক্ষয়ের। অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকে না, যদি সামাজিক উন্নয়ন তৈরি করা না যায়। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান দেশের নানা উন্নয়ন করে উন্নয়ন দশক পালন করেছিলেন, সেই উন্নয়ন আজ কোথায়? কিছু সেতু ও রাস্তার ভগ্নাবশেষ ছাড়া আর কিছু নেই। বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটাই হোক, সামাজিক উন্নয়ন দরকার। বর্তমান বাংলাদেশে সামাজিক জীবনের যে অবক্ষয়, অরাজকতা তা আমাকে শঙ্কিত করে। বাংলাদেশে আগের সুশীল সমাজও নেই। যারা আছেন তারা যদি সুবিধাবাদী নীতি ত্যাগ করে সম্মিলিত হয়ে দেশের মঙ্গলের কথা ভাবেন তাহলে ভালো হয়। বাংলাদেশে রাজনীতি এখন পচনশীল। সুস্থ দেশ গড়তে হলে সুস্থ মানুষ চাই। আমাদের তরুণ সমাজে এ সুস্থতা জন্ম নিক, এই প্রার্থনা করি। বাংলাদেশ হাজার বছরের বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির দেশ। এটাই বাঙালির বৈচিত্র্য। এ বৈচিত্র্য রক্ষা করা না গেলে বাঙালিকে এক জাতি করে গড়ে তোলা যাবে না। আমরা যেন এই কথাটা মনে রাখি।

শেয়ার করুন