আমরা ২০২২ সালে পদার্পণ করলাম। এখানে আমরা বলতে আমাকে বুঝিয়েছি। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, আমার ২০২১ সাল পেরোনোর সম্ভাবনা কম। আমি নানা রোগে আক্রান্ত; সুতরাং ২০২২ সালের মুখ সম্ভবত দেখে যেতে পারব না। কিন্তু বিধাতার অপার কৃপায় ২০২২ সালে… লিখছি। এখন দেখা যাক ২০২৩ সাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারি কি না।
বিশ্ব আজ এক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন, মনে হয় এই করোনা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমরা এক নতুন যুগে, নতুন সভ্যতায় পদার্পণ করতে যাচ্ছি। ভূ-রাজনীতি আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমেরিকা আজ ধনবাদী বিশ্বের নেতৃত্বের পদে নেই। এই পদটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে কমিউনিস্ট চীন। গত শতকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের লড়াই ছিল কমিউনিজমের সঙ্গে। আমেরিকা ছিল তার নেতা। আজ আমেরিকার বিশ্ব আধিপত্য পতনের দিকে। চীন সর্বত্র অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। এটা ঠেকানোর জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রবল চেষ্টা করেছেন, পারেননি।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন ক্ষমতায় আসেন তখন মনে হয়েছিল আমেরিকা চীনের প্রতি নরম পন্থা গ্রহণ করবে। বাইডেন কথা বলেন কম, যাও বলেন তা অত্যন্ত নরম কণ্ঠে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেল তিনি আফগানিস্তানে অত্যন্ত অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছেন। চীনকে শুধু হুমকি দিচ্ছেন না, চীনকে জব্দ করার জন্য ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কোয়াড নামে একটি জোট গঠন করেছেন। চীন চেষ্টা করছে এই কোয়াডে যেন এশিয়ার আর কোনো দেশ যোগদান না করে। বাংলাদেশ তাই চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে আমেরিকা ও ভারতের চাপ কোয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য, অন্যদিকে চীনের চাপ বাংলাদেশ যেন কোয়াডে যোগদান না করে। এই দুই চাপে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের টিকে থাকা মুশকিল! কোয়াডে রয়েছে ভারত। ভারত আমেরিকাকে দিয়ে কোয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার বেশির ভাগে চীনের সাহায্য রয়েছে। বাংলাদেশের আমলা ও ব্যবসায়ীদের ভেতর একটা বিরাট চীনপন্থী মহল গড়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা তাই এই সংকটে কোন দিকে যাবেন, কিভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবেন এবং উন্নয়নের গতি রক্ষা করবেন—এই চিন্তা-ভাবনায় পড়েছেন বলে মনে হয়।
একদিকে ভূ-রাজনীতির এই সমস্যা, অন্যদিকে করোনার নব নব সংস্করণের আক্রমণ বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ব্রিটেনে এখনো মৃত্যুহার ভয়াবহ। বৈজ্ঞানিকরা বলতে পারছেন না এই বিপদ কবে দূর হবে। করোনার আবির্ভাব সারা বিশ্বে একটা পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মানুষ আগের মতো মেলামেশা করতে পারে না। মুখে মাস্ক পরে ঘুরতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এর পরও এক নতুন বিশ্ব ও সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠছে। মনে হয়, আমেরিকা কোয়াড গঠন করেও আগের আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সামাজিক ব্যবস্থায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট পরিবর্তন আসবে। অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে যাবে। সংবাদপত্রের বাজারের পতন ঘটবে। সবাই অনলাইনে কাগজ পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য-ব্যাংকিং চলবে অনলাইনে। এই প্রত্যক্ষ সম্পর্করহিত সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর মানবতার উপকার করবে, না অপকার করবে তা এখন দেখার বিষয়।
ভবিষ্যতে পৃথিবী কী চেহারা ধারণ করবে, তার সমাজব্যবস্থা কেমন হবে এটা এখন বলা মুশকিল। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞানী মনে করেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের পর যেমন যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার শুরু হয়েছিল, তেমনই বর্তমান করোনা বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্ব আরো বেশি যন্ত্রনির্ভর হবে এবং এক নতুন সভ্যতার উন্মেষ ঘটাবে।
আমরা যাঁরা বাংলাদেশে আছি, আমাদের সৌভাগ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী একজন অণুবিজ্ঞানী ছিলেন এবং তাঁর ছেলে জয়ও একজন নামকরা টেকনোক্র্যাট। তাঁরা যদি দেশের নেতত্বে থাকেন, তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মতো একটি টেকনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারেও তাঁরা পথ দেখাতে পারবেন। বাংলাদেশে মধ্যযুগীয় রাজনীতি আর চলবে না। বিএনপি ও জামায়াত যতই চক্রান্ত করুক এই রাজনীতির পতন অবশ্যম্ভাবী। বিশ্বে যে নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি গড়ে উঠবে তাতে যন্ত্রের প্রভাব থাকবে অনেক বেশি। বাংলাদেশ যদি সময়মতো এই নতুন সভ্যতার সঙ্গে যোগ মেলাতে পারে, তাহলে ২০২২ সালে বলা যায় বাংলাদেশ সংকট কাটিয়ে উঠবে, তার ভয় করার কিছু নেই।
সম্প্রতি দেখলাম মির্জা ফখরুল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার জবাবে গণফোরামের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোকাব্বির খান মির্জা ফখরুলকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন, সেই প্রশ্ন হলো—বিএনপি যে গণতন্ত্র চায়, তা কি দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানির জন্য? বিএনপি যে গণতন্ত্র চায়, তা কি একুশে আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলার জন্য? বিএনপি যে গণতন্ত্র চায়, তা কি গণভবনকে আবার হাওয়া ভবনে রূপান্তরিত করার জন্য? এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পেলে তাঁরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আসতে পারেন। আমি মোকাব্বির খানকে ধন্যবাদ জানাই এবং অপেক্ষা করছি বিএনপি তাঁর প্রশ্নের কী জবাব দেয়।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বেশির ভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। তাই বলে সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হবে এমন কোনো ধারণা পোষণ করা সংগত নয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে। সে রাজনীতি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যযুগীয় রাজনীতিকে সামনে এগোতে দেবে না।
খুলনার বিএনপিতে বিদ্রোহ হয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও হচ্ছে। তার কারণ বিএনপির কোনো জাতীয় ইস্যু নেই, যা সাধারণ নির্বাচনে ব্যবহার করতে পারে। দেশের সব স্থানেই বিএনপিতে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে তারেক রহমান বিলেতে বসে ইস্যু নির্ধারণ করে দেবেন তা বোধ হয় সম্ভব হবে না। কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ মিলে নতুন জোট গঠিত হতে পারে। গতবারের নির্বাচনে ধাক্কা খেয়ে তাঁরা এবার বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন কি না সন্দেহ। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু)-সহ অন্য দলগুলো আওয়ামী লীগের মহাজোটে থাকবে কি না তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
আওয়ামী লীগের আসল বিপদ অভ্যন্তরীণ। দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকায় বহু হাইব্রিড নেতা ও কর্মী দলে ঢুকেছেন। দুর্নীতিতে আওয়ামী লীগের মধ্যম ও উচ্চশ্রেণির নেতারা জড়িত হয়ে পড়েছেন। এটা এতই দৃষ্টিগোচর যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তায় ভাটা ধরেছে। এখন প্রশ্ন আগামী নির্বাচনের মাত্র দুই বছর বাকি আছে, এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারবে কি না। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আমার টেলিফোনে আলাপ হয়েছিল। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ এবং অন্য বিবাদগুলো সমাধান হয়েছে। ফলে তিনি আশা করেন, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনের আগে খাড়া করে তুলতে পারবেন।
আমার এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে একটা শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রও শক্তিশালী। এই লৌহবলয় ভাঙা আগামী দুই বছরে সম্ভব হবে কি? এটা সম্ভব হবে যদি সভানেত্রী শেখ হাসিনা আরো কঠোর হন এবং দল পুনর্গঠনে এগিয়ে আসেন। আমি এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর উচিত শেখ রেহানা অথবা জয়কে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সভাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হোক। তাহলে দল সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব ও নতুন উদ্যোগ আশা করা যায়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব কামারুজ্জামানের কাঁধে ন্যস্ত করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিরাট সাফল্য লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগের এখন প্রাচীন বটগাছের অবস্থা। এই বটগাছে ঝাড়া দিলে অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তির পতন ঘটবে। শেখ হাসিনা আরো সবল হাতে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন।
আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে এখন কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন নেই। সুতরাং আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনে একটু যত্নবান হলে আওয়ামী লীগই আসবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে এই সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগের মধ্যম স্তরের নেতারা যদি গা ঢেলে দেন, তাহলে সর্বনাশ হবে। মির্জা ফখরুল, গয়েশ্বর প্রমুখ বিএনপি নেতাকে আমি জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতা মনে করি না। গতবার তাঁরা ড. কামাল হোসেনকে ভাড়া করে তাঁদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতার পদে বসিয়েছিলেন। কিন্তু তারেক রহমান তাঁকে কোনো ক্ষমতা দেননি। প্রথমে তারেক রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ডা. বি চৌধুরীর সঙ্গে, তারপর করেছেন ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে।
ড. কামাল হোসেন তারেক রহমানের দুর্বৃত্তপনা সবই জানেন। তবু তাঁর সঙ্গে নির্বাচনে হাত মিলিয়েছিলেন হাসিনা-বিদ্বেষ থেকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির পক্ষে ড. কামাল হোসেন ডুবেছেন। তাঁর দলের একটা অংশ মোকাব্বির খানের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে রাজনীতিতে নেমেছে। আওয়ামী লীগের উচিত হবে তাঁকে উৎসাহ দেওয়া। শাহবাগ আন্দোলনকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, সেভাবে যেন গণফোরামের এই ফ্রন্টকে ধ্বংস করা না হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় গণফোরাম যদি মোকাব্বির খানের নেতৃত্বে সততা দেখায়, তবে নির্বাচনে তাদের সঙ্গী করা আওয়ামী লীগের উচিত হবে। এবারের নির্বাচনে বহু স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়াবেন। আওয়ামী লীগকে তাই সতর্কতার সঙ্গে প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে এবং দল থেকে দুর্নীতি দূর করার ব্যাপারে আপসহীন হতে হবে। আওয়ামী লীগে দুষ্ট গরু কারা তা শেখ হাসিনা জানেন। এই দুষ্ট গরু বিতাড়নই হবে আগামী ছয় মাসের কর্তব্য। আমরা যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে আস্থা পোষণ করি, তাঁরা এখনো আওয়ামী লীগের দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। আশা করি আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতে আমাদের আশা পূরণ করবে।
লন্ডন, সোমবার, ৩ জানুয়ারি ২০২২