বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি শিক্ষার্থী যখন স্কুলে পুরোদমে ক্লাস করার অপেক্ষায়, ব্যবসায়ীরা যখন আশার আলো দেখছিলেন, একে একে বিশ্বের অনেক দেশে করোনা হাসপাতালগুলো সরকার বন্ধ করছিল বা করার পরিকল্পনা করছিল তখনই করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন আঘাত হানল। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া নতুন এই ধরনে সারা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বে আবারও বিধিনিষেধ জারি শুরু হয়ে গেছে। হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। প্রতিবেশি ভারতেও টানা পাঁচদিন সংক্রমণের উচ্চগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে হুহু করে বাড়ছে সংক্রমণ
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে ২৫ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। তারা আরো সতর্ক করেছেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে চলতি বছরের শুরু থেকেই আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের ইমার্জেন্সি মেডিসিনের অধ্যাপক মেগান রানি বলেন, ওমিক্রন আছে সর্বত্র। পরিস্থিতি এমন যে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে বলে মনে হচ্ছে। ফেডারেল সরকার বা রাজ্য সরকারের নীতিগুলোর কারণে নয়, বরং অনেকের অসুস্থতার কারণেই অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এই সপ্তাহে সাত দিনের গড়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে আমেরিকা। রবিবারও প্রায় ৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। দেশটিতে ৫ কোটি ৬১ লাখের বেশি মার্কিনি সংক্রমিত এবং প্রায় সাড়ে আট লাখ মারা গেছে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ডিজস্ট্যার মেডিসিনের প্রধান ডা. জেমস ফিলিপ বলেন, মহামারির মধ্যে এই অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭৮ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে যেখানে ডেলটার ধরনের আক্রান্তের সময় এই সংখ্যা ৩৪২ জন।
নিউ ইয়র্ক সিটিতে মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি (এমটিএ) কর্মীরা বিভিন্ন লাইনের মেট্রোরেল পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছেন। সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির পরে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোও বিপর্যস্ত। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড ক্যাপিটাল কোভিড পরিষেবায় স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা পুনরায় স্কুল খোলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উচ্চ সংক্রমণে পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে স্কুলগুলো খুলে রাখা কঠিন হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্কুল শিক্ষক, বাসচালক, ক্যান্টিন কর্মীরা করোনা আক্রান্ত হলে শিক্ষার্থীদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। ম্যাসাচুসেটস টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন এই সপ্তাহে রাজ্য শিক্ষা কমিশনারকে স্কুলগুলো বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছে। তবে ওমিক্রনের বৃদ্ধির মধ্যেও নিউ ইয়র্কের কিছু স্কুল চালু করার ঘোষণা দিয়েছে।
ইউরোপে ১০ কোটি অতিক্রম
বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখানে উন্নত হলেও ডেলটার পর ওমিক্রনের চাপে আবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, মহামারি শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে করোনায় সংক্রমিতের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। তা গোটা বিশ্বের মোট করোনা আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। আর ওমিক্রনে আক্রান্তের ৬০ শতাংশই ইউরোপে। গত দুই ইউরোপীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশে (আটলান্টিক উপকূল থেকে রাশিয়া, আজারবাইজান) মোট ১০ কোটি ৭৪ হাজার ৭৫৩ জন কোভিড আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে বিশ্বের মোট সংক্রমণ সংখ্যা ২৯ কোটির বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞদের আশংকা এজন্য যে, ইউরোপের ১০ কোটির বেশি সংক্রমণের মধ্যে আধ কোটি সংক্রমণ ঘটেছে গত সাত দিনে। ৫২টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশে প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড সংক্রমণ ঘটছে। কেবল ফ্রান্সেই এক সপ্তাহে ১০ লাখের বেশি সংক্রমণ ঘটেছে। প্রতি লাখ বাসিন্দার মধ্যে কোভিড পজিটিভ হওয়ার সংখ্যাতেও এগিয়ে ইউরোপ। ডেনমার্কে ২০৪৫, সাইপ্রাসে ১৯৬৯ এবং আয়ারল্যান্ডে ১৯৬৪। মন্দের ভালো এই যে, ইউরোপে ডেলটা কমে ক্রমশ ওমিক্রন ধরনের আক্রান্ত বাড়ছে। এটি ডেলটার চেয়েও ৭০ গুণ বেশি সংক্রামক। কিন্তু এই সংক্রমণে রোগীর শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয় না। ফলে মৃত্যুর হার কম।
ব্রিটেনে হাসপাতালগুলোতে প্রচণ্ড চাপ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে কোভিড-১৯ পরিকল্পনা কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। ব্রিটেনে দৈনিক ১২ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ইংল্যান্ডে মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ক্লাসে আসার আগে সবাইকে করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
দিল্লিতে সংক্রমণের ৮৪ শতাংশই ওমিক্রন
ওমিক্রনের হাত ধরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতে। লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। মুম্বাই-গোয়ার একটি ক্রুজের ৬৬ জন যাত্রী কোভিড পজিটিভ। অন্যদিকে আতঙ্কের পরিবেশে শিক্ষার্থীদের অফলাইন ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মুম্বাইয়ে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অফিসগুলোতে বায়েমেট্রিক হাজিরা বন্ধ করে দিয়েছে।
ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যায় দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে দিল্লি। দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন জানিয়েছেন, ২০২১-এর ৩০ এবং ৩১ ডিসেম্বররে মধ্যে সেখানে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই ওমিক্রন সংক্রমণের ঘটনা। সরকারি সূত্র জানায়, ২৪ ঘণ্টায় দিল্লিতে ৪ হাজার নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দিল্লিতে সংক্রমণের হার (পজিটিভিটি রেট) বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ওমিক্রনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মহারাষ্ট্রে। করোনার জেরে ২০২০ সাল থেকে বারবারই থাবা বসছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিশুরা যেতে পারছে না স্কুলে। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফের তালা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ। ভারতে গতকাল ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৫০ জন। রবিবার তা ছিল সাড়ে ২৭ হাজারের সামান্য বেশি। শতকরা হিসাবে সোমবার তা লাফ দিয়ে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।