আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ (আইএসআই) সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারবিরোধী লেখক, বুদ্ধিজীবী, ইসলাম ধর্মপন্থি সংগঠনের নেতা ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থাটির পক্ষে কাজ করছেন। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে মদদ দেওয়া এবং আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার প্রেক্ষাপটে আইএসআইয়ের এবারের অপতৎপরতা ‘উদ্বেগের’ বলে মনে করে দেশের সরকারি গোয়েন্দা সূত্রগুলো।
সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আইএসআই সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব রটাতে কাজে লাগায় ফেসবুক ও ব্লগসহ অনলাইনকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ কয়েক নেতার সঙ্গে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক ও ফোনালাপের কথা ফাঁস হয় দেশি-বিদেশি পত্রিকায়। তারা ক্ষমতায় যেতে আইএসআইয়ের সহায়তাও চান।
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাটি এবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগাতে তৎপর। পাকিস্তানের কয়েকটি শহর থেকে ও ঢাকাসহ বিভিন্ন দেশে বসে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় বিভিন্ন নামের ফেসবুক আইডি ও পাতা থেকে সরকারের উন্নয়ন ও প্রগতিশীল কার্যক্রমগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের আছে দেশ ও বিদেশে ‘প্রোপাগান্ডা স্কোয়াড’, যারা প্রযুক্তি জ্ঞানে খুব দক্ষ। ‘স্কোয়াডের’ পেছনে আইএসআইয়ের প্রতিমাসে খরচ হওয়া টাকার পরিমাণ কতো, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দেশের গোয়েন্দাদের এখনো জানা নেই।
বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল ও উদার রাজনীতিবিদদের তালিকা সাজিয়ে তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এমনিতেই সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ বিশ্বজুড়ে। ২০২০ সালের শুরুতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সারা বিশ্বে ভুল তথ্য ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। গুজবের বিরুদ্ধে এ দেশীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো লড়াইরত। এমন একটা সময়ে আইএসআইয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজে লাগিয়ে অপতৎপরতা ‘উৎকণ্ঠার’ বিষয় বলে মনে করেন দায়িত্বশীলরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা মত ও পথকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশন হোয়াটসঅ্যাপে গোপন একটা গ্রুপ চালু করেছে। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের কয়েক মাস আগে গ্রুপটি চালু হয়। এতে বিএনপি-জামায়াতপন্থি নাগরিক সমাজ, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকরা আছেন। এটা থেকে সরকারবিরোধী কথিত তথ্য ও বিকৃত ব্যাখ্যা সংগ্রহ করে দেশ ও বিদেশে বসে বিভিন্ন আইডি থেকে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়ানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটির নেপথ্যে আছে আইএসআই। গ্রুপের মাধ্যমে ধর্মকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত নানা প্রচারণা চালানো হয়। আইএসআই স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে ভুল তথ্যের পাশাপাশি বানোয়াট তথ্য প্রচার করায়। গ্রুপটির বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে তাদের অপপ্রচার।’
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের আমলে ২০১৫ সালে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদকে জঙ্গি–সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয়। এর পরের বছর জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে লেনদেনের সময় আটক হওয়া পাকিস্তান হাইকমিশনের ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানকে প্রত্যাহারের পর আইএসআই এ দেশে নিজেদের লাগাম কিছুটা টেনে ধরে।
তবে ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য ‘দোস্তি’ কার্যক্রম চালু রাখার মাধ্যমে সংস্থাটি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। ঢাকার বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে কর্মরতদের ‘দোস্তি’র আওতায় পাকিস্তান ভ্রমণে নেওয়া হয়। ঢাকায় ফিরে তারা লেখায় পাকিস্তানকে ইতিবাচক ও ভারতকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার কথা বলে দেওয়া হয়। এমনকি ধর্মীয় উগ্রবাদের পক্ষে কথা বলার যুক্তির বিষয়ে কাউকে কাউকে প্রশিক্ষণও দেয় আইএসআই।
তথ্যমতে, গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে জয়ী করতে আইএসআইয়ের কাছে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহায্য চান। একপর্যায়ে তিনি চীনকে ‘ম্যানেজে’র জন্য মেহমুদ নামে একজনের কাছে সাহায্য চান। ড. মোশাররফ ও মেহমুদের কথোপকথনের অডিও নিয়ে থাইল্যান্ডের নিউজ পোর্টাল ‘এশিয়ান ট্রিবিউন’ প্রতিবেদন প্রচার করে। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়। বিএনপি বিষয়টিকে ‘দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করে। এশিয়ান ট্রিবিউন’ জানায়- ৭ মিনিটের ফোনালাপটির বিষয়ে তাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলা ছায়াযুদ্ধের একটি কেন্দ্র আফগানিস্তান। আপাতত এ যুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী। ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার ও আইএসআইয়ের যোগসাজশের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত। দেশের উগ্রগোষ্ঠীগুলো আইএসআইয়ের মদদে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, এ উদ্বেগ ও সতর্কতা তাই আছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর।