আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির মহাসচিব পদে চলতি বছর নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে আছেন যথাক্রমে ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনে তাঁদের দুজনেরই শেষ বছর হতে পারে এবার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই দলই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব সামনে এনে দল গুছানোর পরিকল্পনা করছে। দুই দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র মত ও পথকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদের ও বিএনপির মহাসচিব ফখরুলের রাজনৈতিক অবস্থান দুটি বিপরিত মেরুতে। কাকতালীয়ভাবে দুজনকে দলের ‘দ্বিতীয় প্রধান নেতা’র পদের দায়িত্ব ছাড়তে হতে পারে একই বছর। দায়িত্বপালনের সময়কালে তাঁদের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ নিয়ে দুইদলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা বিশ্লেষণ চলছে। দুইনেতার পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মিল ও অমিল নিয়েও আলোচনা আছে।
কাদের ও ফখরুলের ছোট দুই ভাই দেশের দুটি পৌরসভার মেয়র। দুজনের নামের মধ্যেও রয়েছে মিল। একজনের নামের শুরুতে মির্জা, আরেকজনের শেষে মির্জা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদেরের ছোটভাই আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র। ফখরুলের ছোটভাই মির্জা ফয়সল আমিন ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র। গত বছরের শুরুতে হঠাৎ করে সেতুমন্ত্রীর ছোট ভাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতা সম্পর্কে ‘উল্টা-পাল্টা’ বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। সংসদ সদ্স্যদের দুর্নীতি ও নির্বাচনব্যবস্থায় অনিয়ম নিয়ে কাদের মির্জার বক্তব্য সারা দেশে ঝড় তুলে।
কখনো ফেসবুক লাইভে, কখনো সংবাদ সম্মেলনে, কখনো-বা জনসভায় তিনি পরিবার, দল ও দেশের নির্বাচনব্যবস্থার অনিয়ম নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ তুলেন। তাঁর ‘সত্যবচন’ আঞ্চলিক রাজনীতি ছাপিয়ে অস্বস্তি তৈরি করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। যা সরকারের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এসবের মধ্য দিয়ে বড় ভাই ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাদেরের সঙ্গে তাঁর ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের’ কথা প্রকাশিত হয়। মির্জা ফখরুলের সঙ্গে তাঁর ছোট ভাইয়ের এমন ‘বাকযুদ্ধের ঘটনা’ ঘটেনি।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ আছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এবার দলটির সম্মেলন হতে পারে- এ গুঞ্জনের শুরু গত বছর থেকে। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ সংবাদমাধ্যমকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জানান, আগাম সম্মেলন আয়োজনে দলের শীর্ষ পর্যায়ে ভাবনাচিন্তা আছে। এরপর থেকে গুঞ্জন ডালপালা গজায়।
সূত্র বলছে, যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের রাজনীতি ও আগাম সম্মেলনের গুঞ্জন দেশে নতুন নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে গত তিনবার কেন্দ্রীয় সম্মেলনের নির্ধারিত বছরে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগাম সম্মেলনের কথা আলোচনায় এসেছে। তবে এবারের গুঞ্জন বেশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেক নেতা।
তাদের যুক্তি- করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রায় দুই বছর ধরে দলের সাংগঠনিক কাজ প্রত্যাশামতো করা যায়নি। তাছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে (সম্ভাব্য সময়) অনুষ্ঠেয় পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে দলকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সেজন্যই আগাম সম্মেলন হতে পারে। ওবায়দুল কাদের অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে একাধিকবার বলেন- দলের আগাম সম্মেলনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাদের দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছেন। প্রথম মেয়াদে তিনি যতোটা সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে তেমন নন। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও দেশে করোনার প্রকোপের কারণে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি মূলত ঢাকার বাসা থেকে বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে দলকে যথাসম্ভব চাঙা রাখছেন। যদিও আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি দল শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পরিচালনা পুরোপুরি সম্ভব নয় বলে মনে করেন শীর্ষনেতারা।
তাছাড়া দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি বলে অভিযোগ আছে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কাদের। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান।
অন্যদিকে ২০১১ সালে বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলাওয়ার হোসেনের মৃত্যুর চারদিন পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের’ দায়িত্ব দেন মির্জা ফখরুলকে। টানা পাঁচ বছর তিনি ‘ভারযুক্ত’ পদে থেকে ২০১৬ সালে দলের পূর্ণ মহাসচিবের দায়িত্ব পান। ‘পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা’ হিসেবে পরিচিত ফখরুল দলের হাল ধরেন ‘দু:সময়ে’। তিনি দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয়, খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছেও আস্থাভাজন। তবে দলের শীর্ষ পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্ব বিরোধি কয়েকজন সক্রিয় আছেন।
তাঁদের অভিযোগ, আদালতের রায়ে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদার দণ্ডের পর তাঁকে মুক্ত করার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি ফখরুল। এমনকি মহাসচিবের দায়িত্ব পালনকালে তিনি জন ও দলীয় ইস্যুতে এমন কোনো আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে পারেননি, যা সরকারকে নাড়া দিয়ে দাবি আদায় করতে সমর্থ হয়। দলীয় কোন্দল দমাতেও তিনি ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
দলীয় সূত্রের দাবি- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস ও অসুস্থতা, তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবনযাপন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিবেশ নিজেদের ‘অনুকূলে’ না থাকা— সব মিলিয়ে বিএনপির জাতীয় সম্মেলন করার ‘বাস্তবসম্মত’ পরিস্থিতি ছিল না। দল এখন নতুন করে পুনর্গঠন হওয়া ও আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। পুনর্গঠন ও আন্দোলনে দলকে জয়ী হতে হলে শীর্ষ পদগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।