বিশ্বরাজনীতি কেবলই পরিবর্তিত হচ্ছে

মো. শফিকুর রহমান

বিশ্বরাজনীতি
প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনশীল। চলমান কাঠামোতে যখন তার চেয়ে শক্তিশালী নতুন কোনো কাঠামো হাজির হয়, ঠিক তখনই আগের কাঠামো আধিপত্য হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আদর্শিক-দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল কার আদর্শ উত্তম এবং শক্তিশালী সেটি প্রমাণ করতে। সমগ্র পৃথিবী তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল-পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র।

১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পুঁজিবাদী ব্লকের বা পশ্চিম দুনিয়ার প্রধান আদর্শিক উপাদান গণতন্ত্র, উদারতাবাদ এবং বাজার অর্থনীতি জয়ী হয়েছিল। পশ্চিম দুনিয়ার তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন পণ্ডিত ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরের বছর ১৯৯২ সালেই প্রকাশ করেছিলেন তার বিখ্যাত থিসিস ‘The End of History and The Last Man’।

universel cardiac hospital

তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, লিবারেল ডেমোক্রেসি এবং লিবারেল মার্কেট ইকোনমিই রাষ্ট্র পরিচালনায় শেষ গন্তব্য। উল্লেখ্য, পশ্চিমাদের এ উপাদানগুলোকে উত্তর-আধুনিক পণ্ডিত হিসাবে পরিচিতজনরা কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এদের মধ্যে মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ ও দেরিদা এবং ২০২০ সালের মে মাসে প্রয়াত মার্কিন পণ্ডিত রোনাল্ড ইংগলহার্টের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তারা পশ্চিমা আধুনিকতাকেই ‘Instrumental’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

১৯৯২ সালে প্রকাশিত ফুকুয়ামার মতবাদ দুনিয়ায় বেশি দিন আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। কারণ উত্তর-আধুনিক পণ্ডিতদের পশ্চিমা আধুনিকতার নগ্ন সমালোচনা এবং ১৯৯২ সালেই প্রকাশ হয়েছিল জার্মান পণ্ডিত উলরিচ বেকের ‘Risk Society: Towards a New Modernity’ গ্রন্থ। বেক তার গ্রন্থে ফুকুয়ামা ও হান্টিংটনের মতবাদের বিপরীতে যুক্তি দাঁড় করে লিখেছিলেন, পশ্চিমা কাঠামোগত রাজনীতি ও অর্থনীতির বাইরে না এলে ঝুঁকিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হবে বা পরিবেশকে রক্ষা করা যাবে না। নব্বইয়ের দশকের পরই শুরু হয়েছিল জোরদার পরিবেশবাদী আন্দোলন।

প্রায় এক দশক পরই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর পাল্টে গিয়েছিল দুনিয়ার রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা শুরু করেছিল দুনিয়াব্যাপী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। জর্জ বুশ কংগ্রেসের ১০৭তম সেশনে ঘোষণা করেছিলেন, এ সংকট মোকাবিলায় যেসব দেশ আমাদের সঙ্গে থাকবে না তারা সন্ত্রাসীদের পক্ষে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে, কে বা কারা হামলা করেছিল। আমেরিকা ও তার মিত্ররা অনুমানের ওপর নির্ভর করে পরের মাসেই হামলা করেছিল আফগানিস্তানে, যা চলমান ছিল ২০ বছর।

২০০৩ সালে আবার মার্কিন ও তার মিত্রদের হামলা শুরু হয়েছিল ইরাকে। অনেকেই দাবি করে থাকেন, এটি ছিল ১১ সেপ্টেম্বর হামলার প্রতিশোধ। এক দশক পর ইরাকে হামলার ভুল স্বীকার করে টনি ব্লেয়ার তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘For all of this, I express more sorrow, regret and apology than you can ever know or believe’ (https://www.theguardian.com/uk). মূলত দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে কত লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা কত কোটি মানুষ আহত কিংবা গৃহহীন হয়েছে এর কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই; যা আছে সবই অনুমাননির্ভর।

কিন্তু সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী আক্রমণ নামে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল, কোথায় কোনো হামলা হলে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যে, এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পরই রাষ্ট্রীয়ভাবেও বলা হয় এটি সন্ত্রাসী হামলা কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর হামলার আগে পৃথিবী এমনটি ছিল না। পশ্চিমাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রভাব এতটাই ছিল যে, দুনিয়ার প্রায় সব দেশের আইনসভাগুলোতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাশ করা হয়েছে।

বিশ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ইরাক থেকেও মার্কিন বাহিনী চলে গেছে। আফগানিস্তানের ক্ষমতা এখন তালেবানদের হাতে। মার্কিন সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পলায়ন করে পার্শ্ববর্তী দেশ তাজিকিস্তানে নিজের জীবনরক্ষা করেছেন। মার্কিনিদের লেজ গুটিয়ে পালানো স্মরণ করে দেয় ১৯৭৫ সালে সমাজতন্ত্রপন্থি উত্তর ভিয়েতনামিদের হাতে সায়গনের পতনের ঘটনা। তখন মার্কিনরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল, তার ছবি এখনো দুনিয়াব্যাপী বহুল প্রচারিত।

আফগানিস্তান নিয়ে বাইডেন প্রশাসন এখন বলছে, শক্তি প্রয়োগ নয় বরং আলোচনার মাধ্যমেই আফগান সমস্যার সমাধান হতে পারে। বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো ঘোষণা দিয়ে স্বীকারই করেছেন, ৯/১১-এর হামলার জন্য আমরা আফগানিস্তানে হামলা করেছিলাম। কিন্তু দুই দশক ধরে মার্কিন সৈন্যরা যেজন্য যুদ্ধ করেছে, তালেবানরা কি এখন আর তাদের চোখে সন্ত্রাসী নয়? মার্কিনিরা কি এখন আর মনে করে না আল কায়দার উপস্থিতি এখন আর আফগানিস্তানে নেই? দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নয়।

কিন্তু এ বিশ বছরের যুদ্ধে আফগানিস্তানে যত সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে এবং যত নারী পাচার হয়েছে তার দায় কে নেবে? নাকি টনি ব্লেয়ারের মতো মার্কিনিরা এক সময় ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইবেন? সেটি দেখার বিষয়। মূলত মার্কিনিরা বুঝতে পেরেছে দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে তারা পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করেছে, কিন্তু ভূ-কৌশলগত কারণে এখানে যুদ্ধেজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তালেবানের আফগানিস্তানে ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে চীন-রাশিয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নতুন মেরুকরণ।

প্রায় দুই দশক পর করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় পশ্চিমাদের তৈরি করা কাঠামো ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অনেকটাই যেন ম্লান হয়ে গেছে। দুনিয়াব্যাপী এখন শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধ। ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কাঠামো আগের মতো আর কাজ করছে না। সমগ্র দুনিয়াই এখন ব্যস্ত করোনাভাইরাস মোকাবিলায়। দুনিয়াব্যাপী করোনা মহামারি যে আকার ধারণ করেছে, সেজন্য সব দেশই এখন নিজ দেশে এই সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত।

এ ব্যস্ততা নিজ দেশের জনগণের জীবন বাঁচানো নিয়ে। যেখানে প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় সব নাগরিকের জন্য ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করা। ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সব রাষ্ট্রই এখন ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম নামক নতুন রাজনৈতিক জালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ভ্যাকসিনকেন্দ্রিক ভূ-রাজনীতি। পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে রাশিয়া ও চীন ভ্যাকসিনের মেরুকরণে এগিয়ে থাকতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুনিয়ায় করোনাভাইরাস থাকবে। তবে এটি নিশ্চিত কোনো গবেষণা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, ৪ জানুয়ারি ২০২২ সালের বিকাল ৬.১৮টা পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫৪,৪৬,৭৫৩ এবং আক্রান্ত ২৯,০৯,৫৯,০১৯ জন। দেশভিত্তিক মৃত্যুর মিছিলে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ৮ লাখের বেশি মানুষ মহামারি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন।

সমগ্র দুনিয়া আজ করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যেন পুরোটাই চলছে বিপরীত মেরুতে। গত দুই বছরে যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরির পরিবর্তে এখন ব্যস্ত করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি ভ্যাকসিন উৎপাদনে। যুদ্ধ আর নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি এখন যেন আর জাতীয় বীরত্বের প্রতীক নয়। বীরত্বের প্রতীক যেন টেকসই কার্যকর কোভিড ভ্যাকসিন।

মোদ্দা কথা, গোটা দুনিয়াই আজ তাকিয়ে আছে টেকসই ও কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য। লক্ষ্য একটাই-নিজ দেশের মৃত্যু হার হ্রাস করা। পরিবর্তনের ধারায় হয়তো বা আগামী কয়েক দশক পরই বৈশ্বিক রাজনীতির মঞ্চে হাজির হবে নতুন কোনো এক প্রভাবশালী উপাদান, যা চলমান কাঠামোকেও পরিবর্তন করে নতুন কাঠামো তৈরি করবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন