জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিএনপি প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ গড়ার উদ্যোগ নেয় প্রায় প্রতিবার। আগামী বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একইভাবে উদ্যেগ নিচ্ছে দলটি। চলতি বছরের শুরুতে দলের উচ্চপর্যায় থেকে দেশটিতে সফরের পরিকল্পনা আছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে এলে এবং ভারতে ক্ষমতাসীন ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (বিজেপি) ও সরকারের কোনো পর্যায় থেকে সাড়া পেলে বিএনপির প্রতিনিধি দল দেশটিতে সফরে যাবে।
‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে’ বছরের শুরু থেকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ায় আগেভাগেই ভারতকে পাশে চায় বিএনপি। দেশটিকে কূটনৈতিকভাবে পাশে না পেলে দাবি আদায় করা ও প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ আছে বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
‘দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে’ গত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা ভারত সফর ও দেশটির ‘থিংক ট্যাংকের’ সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও দেশটিতে সফর করেন। এতো চেষ্টায়ও ফল পাওয়া যায়নি। গত দুই সংসদ নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হওয়ার বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা পায়নি বলে মনে করেন বিএনপির শীর্ষনেতারা।
তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের ‘আবেদনে’ সাড়া না দিয়ে ভারত ‘একতরফা সমর্থন’ করে আসছে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বের সরকারকে। তাঁদের মনে এবারও তাই প্রশ্ন- ভারত কি বিএনপির বিষয়ে গত একযুগের ‘অবস্থান’ পাল্টাচ্ছে? নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কি বিএনপিকে নিয়ে ‘নতুন ভাবনার’ জন্ম হচ্ছে? তবে বাংলাদেশ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও দলটির সরকারের বাইরে ভারতের ‘নতুন কোনো রাজনৈতিক ভাবনার লক্ষণ’ বিএনপি এখনো পর্যন্ত দেখছে না।
বিএনপির নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বলছে, এবারের আন্দোলনে ‘সফলতা অর্জন’ ও ‘অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে’ ভারতের সমর্থন খুব ‘গুরুত্বপূর্ণ’। দলটি মনে করে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে না পারায় বিশ্বের প্রভাবশালী অন্য কয়েকটি দেশ গত একযুগ বিএনপিকে কূটনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি ও দলটির সরকারের সঙ্গে দেশগুলোর ‘কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো’ ছিল। সেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠায় দলটি ব্যর্থ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ না থাকায়। এ ব্যর্থতার কারণে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে।
ভারতের সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ চাইলেও দেশটির নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের ‘বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে বিএনপিকে কতোটা বিবেচনায় রাখতে চাইছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী- এসব বিষয়ে দলের শীর্ষনেতাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। দলটির সঙ্গে ভারতের দূরত্ব কমেছে কী না জানতে চাইলে দলের কোনো নেতা মত ও পথকে সরাসরি উত্তর দেননি। তাঁরা বলেন- দেশটির বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বিএনপি যোগাযোগ বাড়াবে।
হঠাৎ ভারতের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহের কারণ কী, জানতে চাইলে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন, ‘ভৌগোলিক ও বিশ্বে রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটিকে এড়িয়ে বাংলাদেশের শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নও কঠিন। তাছাড়া ঢালাও বিরোধিতা এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন- বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা সম্প্রতি ভারতের অকারণ সমালোচনার বিষয়ে ‘চুপচাপ থাকার নীতি’ অনুসরণ করে আসছেন। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিষয়েও তারা প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন না। তবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলটির ভারতের প্রতি ‘নমনীয় আচরণ’ শুধুই নির্বাচনী কৌশল। দলটি এখনো নানা কর্মকাণ্ডে অকারণ ভারতবিরোধিতায় মেতে থাকে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ গত ৭ জানুয়ারিও ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘ভারতবিরোধি বক্তব্য’ দেন।
তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে ভারত সফর করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর। দেশে ‘প্রকৃত গণতান্ত্রিক আবহ প্রতিষ্ঠায়’ সাহায্য করার আরজি নিয়েই তাঁরা ভারত যান। সফরকালে তাঁরা দেশটির সংবাদমাধ্যমকে বলেন- সরকারে থাকার সময় ভারতের সঙ্গে বিএনপির বৈরী আচরণ ‘ভুল ও বোকামিপূর্ণ ছিল’।
প্রশ্ন উঠেছে- বিএনপি কি ‘ভারতবিরোধি’ অবস্থান বদলাচ্ছে? নির্বাচনের আগের বছর থেকে রাজনীতির মাঠে ‘ভারতবিরোধি বক্তব্য’ কম দিলেই কি দলটির প্রতি ভারতের ‘নতুন আস্থা’ জন্ম নেবে, বা মনোভাব বদলাবে? বিএনপির প্রতি কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতের কোনো পরিবর্তন আসছে কী না- জানতে চাইলে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন- ‘বিষয়টি নিয়ে মন্তব্যের সময় এখনো আসেনি।’
তাঁর মতে- ‘শুধু নির্বাচনের মাঠের কৌশলী বক্তব্য-বিবৃতি বিবেচনায় নিয়ে একটা দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্য দেশের সরকারের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক সবসময় প্রতিষ্ঠা হয় না। দলটাকেও ভেতরে ও বাইরে আদর্শগতভাবে বদলাতে হয়।’
তথ্যমতে, বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শুরু থেকে পরিচিত ‘ভারতবিরোধি রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে। ‘ভারতবিরোধিতা’ দলটির রাজনীতির বড় অনুষঙ্গ। দলটির উদ্ভব, বিকাশ, নির্বাচনী কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কার্যক্রম, এমনকি নিত্যদিনের রাজনৈতিক বিবৃতিতে এ বিরোধিতার উদাহরণ স্পষ্ট। বিএনপি তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ভারতের কাছে ‘নতজানু’ বলে বরাবরই কোণঠাসা করতে চায়।