কারও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা উচিত নয়

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

সম্প্রতি কক্সবাজারে বিএনপি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা করেছে। পুলিশ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। ১৪৪ ধারা জারি করে মুসলিম লীগ সরকার সভা-সমিতি করতে দিত না। আরমানিটোলার ময়দানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভায় তারা গুণ্ডামি করেছে। এভাবে বিরোধীদের মুখ চেপে ধরে মুসলিম লীগ ভেবেছিল তারা স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। মুসলিম লীগের নুরুল আমীন সরকারের আমলে ৩৫ হাজার রাজবন্দি ছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করায় মনে হয় তারা মুসলিম লীগের নীতি অনুসরণ করছে। আমলাতন্ত্র মুসলিম লীগ শাসনামলে যা করেছে এখন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কক্সবাজারের ডিসি কেন ১৪৪ ধারা জারি করলেন, বিএনপিকে সভা করতে দিলেন না, তার কারণ কী? বিএনপি যতদিন সন্ত্রাস করেছে ততদিন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের দমন করার ব্যবস্থা করেছিল এবং সেটি ছিল স্বাভাবিক। বর্তমানে বিএনপি সন্ত্রাসের নীতি ত্যাগ করেছে। বাংলাদেশে তারাই প্রধান বিরোধী দল। তাদের কথা বলতে না দেওয়া অগণতান্ত্রিক। বিএনপি ক্ষমতায় আসুক, আমরা কেউ তা পছন্দ করি না। বিএনপির ক্ষমতায় আসা মানে জামায়াতি ও হেফাজতিদের ক্ষমতায় আসা। তাহলে দেশ আবার ৫০ বছর পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সেজন্য তাদের নাগরিক অধিকার, কথা বলার অধিকার বন্ধ করা উচিত নয়। এটি গণতন্ত্রসম্মত নয়। বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সহায়তায় দলটি গঠন করেন। তাতে বিভিন্ন দলের এবং জনগণের আস্থাহীন ব্যক্তিদের তার দলে টানেন। তাদের ভেতর কিছু মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসে একইভাবে ১৪৪ ধারার আড়ালে ক্ষমতা স্থায়ী করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ডাকে ঢাকায় এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। খালেদা সরকার জলপথে, স্থলপথে কোনোভাবেই যাতে জনসাধারণ আওয়ামী লীগের সভায় আসতে না পারে, সেজন্য ঢাকা শহরকে অবরোধ করে রেখেছিল। বিএনপি তাই বলতে পারে না আওয়ামী লীগ সরকার অন্যায় করেছে।

কিন্তু বিষয়টি ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার। দেশে এখন আমলাদের শাসন চলছে। তারা অতীতের মুসলিম লীগ সরকারের আমলে যা করতেন, এখন তারই পুনরাবৃত্তি করে প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ সরকারের সুনাম নষ্ট করতে চান। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির প্রতি যে আচরণ করছে, এ একই আচরণ বিএনপি করেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাই মির্জা ফখরুলের গলাবাজি করা উচিত নয়। তাদের আমলে দেশে গণতন্ত্র ছিল না। কিন্তু আজ বিএনপি একটি সন্ত্রাসমুক্ত রাজনৈতিক দল। তাদের সরকার বিরোধিতার অধিকার আছে। তাদের সভা-সমিতি করার অধিকার আছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকার একটি গণতান্ত্রিক সরকার হয়ে তাদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। এর ফলে আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট হবে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তারা গণতন্ত্রের কথা বললেও তা অনুসরণ করছে না। দেশে জামায়াত ও হেফাজতিরা যে ষড়যন্ত্র করছিল তাদের দমনের জন্য শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রয়োজন ছিল। এখন সামনে যখন নির্বাচন আসছে, তখন বিএনপিকে কথা বলতে দেওয়া উচিত। শেখ হাসিনা দেশের অনেক উন্নতি করেছেন। বাংলাদেশের চেহারা তিনি বদলে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়লাভ অনিবার্য। এটি জানা সত্ত্বেও বিএনপিকে কেন হেনস্তা করা হচ্ছে তার কারণ আমাদের অজানা। আমলারাই এটি ঘটাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগকে একটি অগণতান্ত্রিক দল হিসাবে গোপনে তুলে ধরতে চাইছে। আমলাতন্ত্র যখনই দেখেছে কোনো সরকার গণতান্ত্রিক পথে শক্তনীতি গ্রহণ করেছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধেই তারা ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে। এখনো সেই ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত বিএনপির মুখ বন্ধ করা নয়, এ আমলাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার ব্যবস্থা করা।

আগামী নির্বাচনের আর দুবছর বাকি। এ সময় সরকারের উদারনীতি গ্রহণ করা দরকার। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে কথা বলতে দেওয়া উচিত। আমার প্রশ্ন, দেশের এত উন্নতি করা সত্ত্বেও সরকার এত ভীত কেন? গত নির্বাচনে দেখা গেছে, বিএনপি ঐক্যজোট গঠন করেছিল। তারা নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এ অভিযোগ তারা বিগত নির্বাচনগুলোতেও করেছে। এ অভিযোগ খণ্ডন করা সরকারের উচিত ছিল। সরকারের প্রচারণাশক্তি বিএনপির তুলনায় অনেক দুর্বল। তারা সারা বিশ্বে রটিয়েছে, আওয়ামী লীগ রাতের অন্ধকারে ভোট চুরি করেছে। এখন তারা সংগঠিত হচ্ছে এবং নির্বাচনে নামবে মনে হয়। নইলে তারা সভা-সমিতি করত না। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনার জন্য সব দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিএনপি সে আলোচনায় যায়নি। তারা গণতন্ত্রের পথে চলছে, এ দাবি করতে পারে না। দলটি লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশে চালিত হয়। গতবার তার নির্দেশে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ জনগণের আস্থাহীন হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি তাদের নিয়ে ঐক্যজোট গঠন করেছে। কিন্তু দেশের সুশীল নেতাদের দলে টেনে বিএনপি সুবিধা করতে পারেনি। এবার তারা মরিয়া হয়ে নির্বাচনে জয়ী হতে চাচ্ছে। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে জামায়াতিদের দমন করেছেন। বিএনপি যদি জামায়াতের সংস্রবমুক্ত হয়, তাহলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা সম্ভব হতে পারে। মির্জা ফখরুলের উচিত গলাবাজি না করে দলটিকে অসাম্প্রদায়িক করা এবং গণতন্ত্রের পথে হাঁটা। জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী ছিল এবং তাদের খুনখারাবির জন্য জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীকে সাহায্য জুগিয়েছে এবং গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছে। এ দলকে বিএনপি কেন ক্ষমতার অংশীদার করতে চায়?

বিএনপি বর্তমানে নেতৃত্বহীন। খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং দুর্নীতির কারণে দণ্ডিত হওয়ায় রাজনৈতিক কথাবার্তা বলা থেকে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছেন। তার অসুস্থতার জন্য দেশে চিকিৎসা হতে পারে। কিন্তু তাকে চিকিৎসার নামে লন্ডনে পাঠানোর জন্য আন্দোলন করা হচ্ছে। এ আন্দোলন সফল হবে না। কিন্তু সরকারের উচিত বিএনপিকে কথা বলতে দেওয়া। তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করা নয়। তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুনাম থাকবে না। আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের মুসলিম লীগ সরকারকে অনুকরণ করে নির্বাচনে জয়ী হতে চাইলে সফল হতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার বিরাট ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ বেঁচে আছে নেতৃত্বগুণ দ্বারা। কিন্তু আওয়ামী লীগে দুর্নীতি ঢুকেছে ব্যাপকভাবে। আগামী নির্বাচনে যাদের টাকার জোর আছে তাদের মনোনয়ন না দিয়ে সৎ ও আদর্শবান প্রার্থীদের মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের জয় অনিবার্য। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছু নেই। কিন্তু মনে হয় বিএনপিকে তারা ভয় পাচ্ছেন। এ ভয় সম্ভবত আওয়ামী লীগকে পেয়ে বসেছে। বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে আওয়ামী লীগ সরকারের সুনাম নষ্ট করা হচ্ছে। আগেই বলেছি, শেখ হাসিনা এখন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী। তার বিরুদ্ধে নেতৃত্বহীন বিএনপি কী করতে পারে? সুতরাং তাদের কথা বলতে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত তারা যে গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করছেন, তা প্রমাণ করা।

কিন্তু আওয়ামী লীগকে জনগণের আস্থা ধরে রাখার জন্য গণতন্ত্রের পথ অনুসরণ করতে হবে। কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করলে তা নির্বাচন জয়ে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করবে না। সন্ত্রাস দমন, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির নিয়ন্ত্রণে সরকারের কর্তৃত্ববাদী নীতি নেওয়া উচিত ছিল। বিএনপি জনগণের আস্থা হারিয়ে এখন সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করেছে। তারা দেশের প্রধান বিরোধী দল। তাদের কথা বলার অধিকার হরণ করা উচিত নয়। সামনে নির্বাচন। এ দুই বছরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা দরকার। এখন আওয়ামী লীগ হাউব্রিডদের কবলে পড়েছে এবং জনগণের আস্থা হারিয়েছে। শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ দলের পুনর্গঠন হওয়া উচিত। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছু নেই। দলটিতে না আছে ঐক্য, না আছে নেতৃত্ব। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত উদারনীতি গ্রহণ করা এবং বিএনপিকে কথা বলতে দেওয়া।

শেয়ার করুন