বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়া ও কারাবাসের সময় তাঁর মুক্তির দাবিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ‘মুখরক্ষার কর্মসূচি’ দলটির উদ্যোগে তখন পালিত হলেও সেগুলোতে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে হাতেগোণা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা অনুপস্থিত থাকতেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর উপস্থিতিও থাকত কম। কর্মসূচিস্থলের চারপাশে ‘নিরাপত্তার দায়িত্বে’ যতো পুলিশ থাকতেন, অনেক অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা আরো কম হতো বলে অভিযোগ আছে।
বিএনপির শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়েই নয়; মহানগর, নগর, জেলা ও থানা পর্যায়ে সারাদেশের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতির চিত্র একইরকম ছিল। দলটি সরকারবিরোধি কোনো আন্দোলন ও কর্মসূচি ঘোষণা করলে তাদের ব্যর্থতার কথা প্রতিপক্ষ সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারাও বক্তব্যে তুলে ধরতেন। এতে টানা প্রায় তিন মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ে। মামলা আতঙ্কে অনেকেই চলে যান আত্মগোপনে। তবে ২০২১ সালের শেষদিক থেকে দলীয় ‘রাজনীতির দৃশ্যপট’ পাল্টাতে থাকে।
বিএনপির সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ বলছে, আগের অবস্থান থেকে সরকারের ‘সামান্য উত্তরণ’ ঘটেছে, ‘কর্মসূচি পালনের কিছুটা
সুযোগ’ দিচ্ছে গত বছরের শেষ দিক থেকে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘ধীরে ধীরে চাঙ্গাভাব’ ফিরে আসছে। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি ও ‘দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অায়োজনের দাবিতে’ আয়োজিত কর্মসূচি ও সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা উপস্থিত হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও থাকছেন কর্মসূচিগুলোতে।
কক্সবাজারসহ একাধিক জেলায় ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা ‘সফল’ সমাবেশ করেন। এগুলোর প্রভাব পড়ছে দলের তৃণমূলে। দলীয় কর্মসূচি পালনে বিএনপিকে কোনোভাবে ‘মাঠে না নামতে’ যেভাবে বাধ্য করত, আগের সেই ‘কঠোর অবস্থানে’ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়া ও গণতন্ত্রের মুক্তি- এ দুটিকে ভিত্তি ধরে দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক বিভিন্ন কর্মসূচি আগের তুলনায় বেশি ও তুলনামূলক কম পুলিশি বাধায় পালন করতে পারছে দল। আগের তুলনায় বিএনপির বিরুদ্ধে পুলিশের ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা’ দায়েরের প্রবণতা কমেছে। ফলে আগামীকাল ১২ জানুয়ারি থেকে দেশের আরও ৩৯টি সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশ ডেকেছে বিএনপি।
বিএনপির নেতারা বলেন, সম্প্রতি র্যাব ও তাদের সাত সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপির চলমান কর্মসূচির মধ্যে এমন ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও আগের তুলনায় নিরপেক্ষতা দেখা যাচ্ছে। সমাবেশগুলোয় তেমন কোনো বাধা আসছে না। যার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যেও সক্রিয়ভাব এসেছে। ‘ভয় ও শঙ্কা’ কাটিয়ে দলকে সক্রিয় করে চূড়ান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পরিকল্পনায় নিয়েই এগোচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা।
যোগাযোগ করলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘হামলা, মামলা, গুম ও খুনসহ নানা নির্যাতনের কারণে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে। বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে জনস্রোত নামছে। মানুষ এখন ১৪৪ ধারারও পরোয়া করছে না। মানুষ এখন চিন্তা করতে পারছে দেশে পরিবর্তন হবে।’
মামলা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আজ মঙ্গলবার বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে অকারণে মামলা হয়নি। তাঁরা হামলা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলেই মামলা হয়েছে।’
বিএনপির সূত্র জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দলের নির্বাহী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠক করেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির কী করা উচিত, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হওয়া উচিত, মাঠ পর্যায়ের সংগঠনকে আরও সক্রিয় করতে কী করা প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন তারা। বৈঠকে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে দলের ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে নির্বাহী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কমিটির নেতারাও মতামত দেন। মতামত নেওয়া হয় বিএনপিপন্থি নানা পেশার মানুষের কাছ থেকেও।
দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতা বলেন, ওই বৈঠক বিএনপির ‘রাজনীতির মোড়’ ঘুরিয়ে দেয়। বৈঠকের লক্ষ্য ও সিদ্ধান্ত দলীয় কার্যক্রমেও প্রতিফলিত হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে অনেকেরই মতবিনিময় হয়। আগে যেমন স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা এবং জেলার নেতাদের সঙ্গেও এখন কথা বলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
নেতাদের দাবি, বিএনপির ওই ধারাবাহিক বৈঠকে একদিকে যেমন দলের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়, তেমনই ভবিষ্যতে সরকারবিরোধি আন্দোলনের একটি বার্তাও সারাদেশে দেওয়ার চেষ্টা হয়। ‘নির্দলীয় সরকার’ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যে অংশ নিচ্ছে না- দলের এমন বার্তাও আওয়ামী লীগ সরকারসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ‘ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের’ দাবিতে একটি বৃহত্তর ঐক্যের নতুন ফর্মুলা দাঁড় করাচ্ছে দলটি। তাতে বহুল আলোচিত ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো পুরোনো জোটকাঠামো আর থাকছে না।
বিএনপির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারবিরোধী সব পক্ষকে একসূত্রে গাঁথার যে ভাবনা নিয়ে তারা এগোচ্ছে, সেটি পুরোনো জোটকাঠামো বহাল রেখে সম্ভব হচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে সব পক্ষকে ন্যূনতম দাবিতে এক সুরে আনতে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টকে ভিন্ন কোনো কৌশলে আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখার কথা ভাবা হচ্ছে।