চীনের ঋণে দেউলিয়া হওয়ার পথে শ্রীলঙ্কা

হাসান শান্তনু

ফাঁদে পড়ছে পাকিস্তানসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ

শ্রীলঙ্কা দাঁড়িয়ে আছে একটি গভীরতর আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ২০২০ সালে মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি এমন- দেশটি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে! গত বছরের ৩০ আগস্ট শ্রীলঙ্কা সরকার দেশের মুদ্রার তীব্র পতনের পরে ‘আর্থিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে। যা দেশের সংকট সমাধানের বদলে খাদ্যের দাম বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

‘কলম্বো গেজেট’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে কলামিস্ট সুহেল গুপ্তিল উপরের কথাগুলো তুলে ধরেন। তাঁর মতে, শ্রীলঙ্কা ক্রমাগত জোড়া ঘাটতির মুখোমুখি- এক. রাজস্ব, দুই. বাণিজ্য। ২০১৪ সাল থেকে দেশটির ঘাড়ে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ছে। ২০১৯ সালে তা জিডিপির ৪২.৬ শতাংশে পৌঁছায়।

গুপ্তিল ব্যাখ্যা করেন- শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান বিদেশি ঋণ ২০১৯ সালে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অংকে পৌঁছায়। যা গোটা দেশের উপর বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস’, মুডি’স এবং ফিচসহ বেশ কয়েকটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি শ্রীলঙ্কার ক্রেডিট রেটিং ‘সি’ থেকে ‘বি’তে নামিয়ে আনে। যার জেরে ‘আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের’ (আইএসবিএস) মাধ্যমে তহবিলপ্রাপ্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীনা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশ। কূটনীতির পরিভাষায় চীনের এ নীতিকে বলা হচ্ছে ‘ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে চীনের এ ঋণ ফাঁদ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। চীনা অর্থায়ন রয়েছে নেপাল ও মালদ্বীপেও। গরিব দেশগুলোকে চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে, এর কারণে দেশটির সমালোচনা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ- ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রহিতা দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে।

তবে চীন এসব অভিযোগ ‘প্রত্যাখ্যান’ করে বলছে, তাদের ‘ভাবমূর্তি’ বিনষ্ট করার জন্য পশ্চিমের কয়েকটি দেশ এ ধরনের বক্তব্য প্রচার করছে। এমন একটি দেশ নেই, যারা চীনের কাছ থেকে অর্থ ধার করার কারণে তথাকথিত ঋণের ফাঁদে পড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে- গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বেড়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। ঋণের পরিমাণ হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটা’র এক গবেষণা বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, তার অর্ধেকই সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়নি। এসব ঋণ প্রায়শই সরকারি হিসাবপত্রের বাইরে রাখা হয়।

কোনো দেশের সরকারকে দেওয়া ঋণকে চীন সরকারের সরাসরি ঋণ হিসেবে না দেখিয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এবং ব্যাঙ্ক, যৌথ প্রকল্প বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। চীন নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’কে (বিআরআই) কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে বিনিয়োগ করছে।

শ্রীলঙ্কায় আর্থিক সংকটের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ি নিম্ন প্রবৃদ্ধির হার, বর্তমানে যা দাঁড়িয়েছে মাত্র চার শতাংশে। সেই সঙ্গে বিশাল ঋণ শোধ না করার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগামী ১২ মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কার সরকারি ও বেসরকারি খাতকে দেশি ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে আনুমানিক ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের মতো।

চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে’ আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডখাতে’ শ্রীলঙ্কাকে দিতে হবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার জন্য সবচেয়ে চাপের সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো- এর বিশাল বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিষেবার বোঝা, বিশেষ করে চীনের প্রতি।

চীনের কাছ থেকে ইতিমধ্যে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা। গত বছর তীব্র আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। যা কিস্তিতে পরিশোধ করছে দেশটি।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউ এ উইজেবর্ধন সতর্ক করে আর্ন্তজাতিক একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম আর্থিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। যা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে।

করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে শ্রীলঙ্কার পাঁচ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন কাটাচ্ছেন।

চীনা অর্থায়ন রয়েছে বাংলাদেশেও। অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন নিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও দক্ষতার সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থাপনা করায় বাংলাদেশে চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা নেই বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত হয়। এসব প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশকে কখনো চীনের কথিত ঋণের ফাঁদে পড়ার চিন্তা করতে হবে না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতায় ঋণ কখনো কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে উঠবে না। বাংলাদেশ খুব দক্ষতার সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করে আসছে। এ দেশে চীনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো ঋণ নেই। আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেছে।’

শেয়ার করুন