মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। যন্ত্র যখন মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দেখায়, সেটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তি, সমস্যা সমাধান, মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা, উপলব্ধি, শিক্ষণ, পরিকল্পনা, কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো বা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র। উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার, রোবট এর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৫ সালে জন ম্যাকার্থি সর্বপ্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টার্মটি ব্যবহার করেন। পরের বছর নিউ হ্যাম্পশায়ারের হ্যানোভার শহরস্থ ডার্টমাউথ কলেজে অনুষ্ঠিত এক একাডেমিক কনফারেন্সে তিনি তা উপস্থাপন করেন। এ জন্য জন ম্যাকার্থিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম জনক বলা হয়।
গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে মানুষ যা আবিষ্কার করে, তা সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আবিষ্কারের চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আলফ্রেড বি নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় ভেঙে যাতায়াতের জন্য সুড়ঙ্গ বা রাস্তা তৈরির উদ্দেশ্যে। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার বিকাশ সাধনই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডিনামাইট যুদ্ধে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও সমাজের কাজকে সহজ করার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় পরিবহন ব্যবস্থা, সাইবর্গ টেকনোলজি, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধান ইত্যাদি কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ অপরিহার্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবে আমরা আমাদের ডিভাইস থেকে যে ধরনের অনুসন্ধানগুলো করি, সেই অনুসন্ধানগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আমাদের আবেগ, মনের পছন্দ ও চাহিদাগুলোকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যগুলোর ছবিসহ দাম বিভিন্ন সময় আমাদের ডিভাইসের স্ক্রিনে তারা উপস্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি শাখা—মেশিন লার্নিংয়ের অংশ। প্রত্যেক ইউজারের মনের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন থাকে তার খোঁজার মধ্যে। এই খোঁজার তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে ঠিক ওই ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখানো হয় আমাদের মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ডিভাইসের ডিসপ্লেতে। ডাটাসমুদ্রের এমন একটি বুদ্ধিমান প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি কোনো ব্যবসাকে সমৃদ্ধ ও ত্বরান্বিত করার জন্য নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি নিজে থেকেই নিজের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে, তাহলে তা মানবজাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত গুরুত্বের সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।
একবিংশ শতাব্দীর সাড়া-জাগানো বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একসময় আমাদের অতিক্রম করে যাবে। এর ফলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব এক্সিসটেনশিয়াল রিস্কের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট কোনো অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর নকশা করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান করার জন্য। যেমন—১৯৯৭ সালে তৈরি কম্পিউটারের ডিপ-ব্লু দাবা তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে ছয়টি খেলার একটি ম্যাচে হারিয়ে দেয়। ডিপ-ব্লুকে মানুষ বিশেষভাবে নকশা করেছিল দাবা খেলার জন্য। পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আর সে কথা প্রযোজ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আলফাগো জিরো সফটওয়্যার তিন দিন ধরে নিজের বিরুদ্ধেই ‘গো’ (একটি বোর্ড গেম) খেলার পরে দক্ষতার দিক থেকে সুপারহিউম্যান পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই পদ্ধতি যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততই এটি অতি বুদ্ধির অধিকারী হয়ে উঠবে। এটি হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবে,’ অভিমত এক্সিসটেনশিয়াল রিস্ক সেন্টারের।
২০২১ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে বিশ্বখ্যাত গবেষক স্টুয়ার্ড রাসেল বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিনে দিনে এমনভাবে শক্তিশালী হচ্ছে যে তা মানবজাতির হুমকির কারণ হতে পারে। বিবিসি টুডে অনুষ্ঠানে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি হুমকির একটি কল্পিত উদাহরণ তুলে ধরেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে তৈরি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ধরি, আমাদের একটি শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা আছে, যেটি বিশ্বের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং সেটি ব্যবহার করে আমরা প্রাক-শিল্প পর্যায়ের কার্বন ডাই-অক্সাইড মাত্রার আবহাওয়া ফিরে পেতে চাই। তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক করল যে এটি করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে পৃথিবী থেকে সব মানুষকে সরিয়ে ফেলা। কারণ পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের দিক থেকে মানুষই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ হয়তো বলতে চাইবে, মেশিন তুমি যা চাও সব কিছুই করতে পারবে, শুধু মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না। তখন ওই সিস্টেম কী করবে? এটি তখন আমাদের সন্তান কম নেওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করবে, যতক্ষণ না পৃথিবী থেকে মানুষ শেষ হয়ে যায়।’ এই উদাহরণের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের বিপদের সেই সব দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা মানুষ খুব চিন্তা-ভাবনা করে নির্দেশ না দিলে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।
এ কারণেই অধ্যাপক রাসেল বলছেন, মানুষের উচিত রোবট বা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা। তিনি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রকে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা কাজ ঠিক করে দেওয়া এই সমস্যার সমাধান নয়। কারণ মানুষ নিজেরাই ঠিকমতো জানে না যে মানুষের সঠিক উদ্দেশ্য আসলে কী? মানুষ কোনো কিছু না ঘটা পর্যন্ত তার উপকারিতা বা অপকারিতা উপলব্ধি করতে পারে না। স্টুয়ার্ড রাসেলের মতে রোবটকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ঠিক করে দেওয়া এবং সেটি থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিক্ষা নেওয়ার মতো ধারণা থেকে সরে আসা উচিত। বরং সিস্টেমটি এমন হওয়া উচিত, যেন সেটি জানতে না পারে যে আসলে সে কী উদ্দেশ্যে কাজ করছে। যখন মানুষ এভাবে সিস্টেমটি পরিচালনা করবে, তখন সেটি আসলে মানুষের থেকে পিছিয়ে থাকবে। তারা কোনো কিছু করার আগে প্রশ্ন করতে শুরু করবে। কারণ যন্ত্র তখন আর নিশ্চিত হতে পারবে না যে মানুষ কী চাইছে। এ অবস্থায় যন্ত্রগুলো নিজেদের গুটিয়ে রাখবে। কারণ সেগুলো এমন কিছু করতে চাইবে না, যা মানুুষ অপছন্দ করতে পারে।
উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অযাচিত প্রসার রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণমূলক আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পৃথিবীর বিবেকবান গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী—সর্বোপরি বিশ্বনেতাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়