‘সরকারি আইনজীবীদের’ বিরুদ্ধে আর্থিক নানা অনিয়মের অভিযোগ বাড়ছে। আইনগত দিক থেকে সরকারের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োগ পাওয়া এসব আইনজীবীর মধ্যে অনেকে ‘নিজের স্বার্থ রক্ষায় বেশি ব্যস্ত’ বলে অভিযোগ আছে। তারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে থাকলেও ‘গোপন আর্থিক সমঝোতায়’ আসামিপক্ষকে সহযোগিতা করেন। তাদের পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিকতা, সততা ও যথাযথ জবাবদিহির অভাবে ‘রায় পক্ষে আসার মতো মামলায়’ সরকার হারছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার, অপচয় হচ্ছে জনগণের অর্থের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থায়ী ভিত্তিতে সরকারি আইনজীবী নিয়োগের নির্দিষ্ট আইন ও নিয়মকাঠামো নেই। নিয়োগে বেশিরভাগ সময় ‘দলীয় পরিচয়’ বেশি গুরুত্ব পায়। যে দলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়, সেই দলের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত যারা, সরকারি আইনজীবী হিসেবে তারা বেশি নিয়োগ পান। যুগের পর যুগ ধরে এটা চলছে। দক্ষতার বদলে ‘রাজনৈতিক দলের প্রতি ‘আনুগত্য’ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ায় তাদের মধ্যে অনেকের সঠিক পেশাদারত্বের অভাব থাকে। আইনি লড়াইয়ে তারা রাষ্ট্র ও সরকারের স্বার্থের ধারাবাহিতা ধরে রাখতে পারেন না।
তারা রাজনৈতিক দলের ‘লেজুড়বৃত্তি বেশি করেন ও কোনো গোষ্ঠীর ‘হাতিয়ার হিসেবে’ ব্যবহৃত হন বলেও অভিযোগ আছে। মামলায় সরকারের পক্ষে লড়ে জয়ী হতে শ্রম দিয়ে তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করেন না। বিভিন্ন মামলায় সরকারের পরাজয়ের জন্য তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি অনেকাংশে দায়ি করা হয়। তবে অভিযোগ সবার বিরুদ্ধে কিছুতেই নয়। অনেকেই যোগ্যতা, দক্ষতায় রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
তথ্য বলছে, সরকারি আইনজীবীদের মধ্যে একটা অংশের পেশাগত দক্ষতার অভাবে প্রতিবছর সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়ছে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা। গত পনের থেকে বিশ বছর, বা এরও বেশি সময় আগে দায়ের হওয়া মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না তাদের আন্তরিকতার অভাবে। এতে সরকারি খরচ বাড়বার পাশাপাশি মামলার জট বাড়ছে। নাগরিক, আইনগত অধিকার ও দাবি আদায়ে যারা মামলা করছেন, নিষ্পত্তি না হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের বিরুদ্ধে এখনো ৯৫ হাজারের বেশি মামলা উচ্চ আদালতে চলমান বলে একাধিক সূত্র মত ও পথকে জানায়।
অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ‘সরকারি আইনজীবীরা’ বিভিন্ন মামলায় রাষ্ট্র ও সরকারের স্বার্থে লড়ার কথা। তাদেরকে স্থায়ী ভিত্তিতে ও আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে কোনো আইন নেই। ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন’ প্রণয়নের আগে বা লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি হওয়ার ‘পাকা কথা’ হয়েছিল দেড় দশক আগে। নির্বাচিত সরকারের সংসদে ওই অধ্যাদেশ পাস হওয়া এবং আইন চূড়ান্ত হওয়ার আশাও জেগেছিল। তবে কার্যক্রম এগিয়ে যায়নি। আইনটিও আর হয়নি। অস্থায়ী আইনজীবীর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের আরো নিজস্ব অন্তত এক হাজার ২০০ আইনজীবী আছেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গত বুধবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন- ‘সরকারি কোনো আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণ পেলে বিচার হবে। বিচার করবে বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে আদালত থেকে কয়েক আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বার কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে। এগুলোর বিচার হচ্ছে। আদালত সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আদালতের কমিটি কোনো আইনজীবীকে জরিমানা করলে বার কাউন্সিল অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
দায়িত্ব নিয়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী গত ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত একটি ‘প্রাথমিক অনুসন্ধান’ কমিটি গঠন করে দেন। এক সপ্তাহের মাথায় ওই কমিটি প্রধান বিচারপতির কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রধান বিচারপতি গত ২ জানুয়ারি প্রথম কর্মদিবসে এক অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপারে আমি কম্প্রোমাইজ করব না। কোনো রকম দুর্নীতি হলে আমি সঙ্গে সঙ্গে স্টাফ, অফিসার যে-ই হোক না কেন, সাসপেন্ড করব।’
যোগাযোগ করলে সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী ড. বাবরূল আমিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়ন হলে চুক্তিভিত্তিক আইন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা থাকবে না। এর আওতায় ন্যূনতম আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে আইন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাবেন।’
তথ্যমতে, সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা প্রতি বছর ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর ও চাকরিচ্যুত হওয়ার পর অবসরকালীন ভাতা (পেনশন) না পেয়ে মামলা করছেন অনেকে। যথাযথ সময়ে পদোন্নতি না পাওয়ায় কেউ কেউ মামলা ঠুকে দিচ্ছেন আদালতে। পরীক্ষায় পাস করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না পেয়ে মামলা করছেন অনেকে। বিভিন্ন আইন-বিধি সংশোধন, সরকারি যানবহনে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ও চাকরিতে নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার মামলাও আছে তালিকায়।
হিসাব বলছে, গত চার বছরে এ ধরনের মামলায় পরাজিত হওয়ায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা দাবি পরিশোধ করে সরকার। এগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে দেয় এক হাজার ৮৮ কোটি আর ২০২০ সালে এক হাজার ১০৮ কোটি টাকা। গত ২০১৯ সালে মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৮০০, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৭০০-তে। ২০২১ সালে দায়ের হওয়া মোট মামলার হিসাব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া যায়নি। এর আগে ২০১৬ সালে চার হাজার, ২০১৭ সালে ছয় হাজার ১০০, ২০১৮ সালে ছয় হাজার ৩০০টি, ২০১৯ সালে সাত হাজার ২০০টি এবং ২০২০ সালে সাত হাজার ৯০০টি মামলা হয়। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এসব মামলায় প্রতি বছর সরকারকে ক্ষতি গুনতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক মনে করেন, ‘বেশিরভাগ মামলা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। এসব দপ্তরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যত্নবান হলে মামলার চাপ থেকে আদালত ও সরকার অনেকটা মুক্ত হতে পারবে। সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনায় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে যে সংখ্যক আইন কর্মকর্তা আছেন, তা পর্যাপ্ত নয়। দক্ষতা বিবেচনায় আইনজীবীদের নিয়োগ দিতে হবে।’