টানা ১৪ বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একসময়ের দাপুটে রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। এক-এগারোর কাল থেকে তিনি ‘আত্মগোপনে’ ছিলেন। যুক্তরাজ্যে পালিয়ে ছিলেন- এতোদিন তার সম্পর্কে এমনই বলাবলি হতো। সম্প্রতি মারা যাওয়ার পর পরিবারের সদস্য এবং সিলেট জেলা ও যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি, তিনি ১৪ বছর দেশের ভেতরে ‘আত্মগোপনে’ ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে দীর্ঘ বছর ‘আত্মগোপনে’ কীভাবে ছিলেন, কারা তাকে ‘আশ্রয়-প্রশ্রয়’ দেন- রহস্যঘেরা এসব প্রশ্ন ও তর্ক-বিতর্ক সামনে আসছে।
একুশে আগস্টের নৃশংস গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন হারিছ চৌধুরী। হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী এ নেতার ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি’ মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা ও বিস্ফোরক মামলারও আসামি ছিলেন রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত হারিছ। এক-এগারোর সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ‘দীর্ঘদিন খুঁজেও’ তার সন্ধান না পাওয়ায় একপর্যায়ে ‘ধারণা’ করা হয়, তিনি ভারতের আসাম হয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান।
ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা হারিছের ঢাকায় মৃত্যু ও লাশ দাফন, দেশে তার ‘আত্মগোপনে’ থাকার কথাগুলো গত চার-পাঁচদিন ধরে দেশীয় সংবাদমাধ্যমেই শুধু আলোচিত হচ্ছে। তার প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী জাতীয় একটি দৈনিকের সম্পাদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন- তার বাবা করোনাভাইরাসসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। তিনি আসামে, বা যুক্তরাজ্যে যাননি। বাংলাদেশেই ‘আত্মগোপনে’ ছিলেন। তবে কোথায়, কীভাবে ছিলেন, বাবার লাশ কোথায় দাফন হয়েছে- তা তিনি সাক্ষাৎকারে খোলাসা করেননি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে বিষয়টি নিয়ে এখনো কিছু বলা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা মত ও পথকে এ ব্যাপারে বলেন- ‘হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ, ঢাকায় আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি পত্রিকায় দেখেছি। হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিতর্কিত করতে এটা অশুভ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আরেকটা নতুন চাল।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কীভাবে ‘নতুন রাজনৈতিক চাল’ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন- ‘নিজেকে গোয়েন্দা বাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রেখে দেশের ভেতরে বহুল আলোচিত এক ব্যক্তি কীভাবে ১৪ বছর আত্মগোপনে ছিলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কথিত ব্যর্থতার কথা বলবে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) বর্তমান ও প্রাক্তন ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে ব্যর্থতার গল্প ছড়াতে পারলে তা আলোচনার জন্ম দেবে।’
হারিছ চৌধুরী এতোদিন দেশে ‘আত্মগোপনে’ থাকার তথ্যটি সঠিক নয় দাবি করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘হতে পারে, তিনি মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে দেশে ফিরেন। এটা নানা দেশেই পুলিশ, গোয়েন্দার নজর এড়িয়ে ঘটা সম্ভব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ বিদেশে পলাতক ছিলেন। ২০২০ সালে গোপনে দেশে এলে কয়েক মাসের মধ্যেই গ্রেপ্তার হন, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।’
হারিছের মৃত্যুর সংবাদ প্রথম দেশের প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ, প্রচার হয় গত ১১ জানুয়ারি। প্রায় সাড়ে তিনমাস পর কেন তার পরিবার মৃত্যুর সংবাদ প্রচারমাধ্যমের কাছে ‘খোলাসা’ করলেন, এতোদিন কেন তারা চুপ থেকেছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের ভেতর তার ‘আত্মগোপনে’ থাকার কথা পরিবার ছাড়াও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতা জানতেন বলে পারিবারিক সূত্রের দাবি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে হারিছের মৃত্যু সংবাদের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়নি। দলটির পক্ষে কোনো বিবৃতি, শোকবার্তা দেওয়া হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শনিবার বিকেলে মত ও পথকে বলেন- ‘২০১৫ সালে একবার রটে হারিছ চৌধুরী গোপনে সিলেটে যান। ওই বছর তার মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। কোনোটিই সত্য নয় বলে পরে জানতে পারি।’
যোগাযোগ করলে সিলেট জেলা বিএনপির নেতা আবুল কাহির চৌধুরী শনিবার দুপুরে মত ও পথকে বলেন, ‘হারিছ চৌধুরী ঢাকায় ছিলেন। মারা যাওয়ার পর তাকে ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। রাজধানীর মিরপুরে বাসরত বোনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।’ যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপির সভাপতি এম এ মালিকের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘হারিছ চৌধুরী কখনোই যুক্তরাজ্যে আসেননি। দেশে অবস্থানকালে তার সঙ্গে কয়েক দফা আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে।’
গত ১৪ বছরের মধ্যে হারিছ চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে বিএনপির দলীয় কর্মসূচি, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখেছেন কী না প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কায়সার আহমেদ বলেন- ‘আমি কখনো যুক্তরাজ্যে তাকে দেখিনি।’ তার দারি, আত্মগোপনে থাকাকালে হারিছ কখনো যুক্তরাজ্যে গেছেন কী না, তা তার জানা নেই। তার মৃত্যুর সংবাদ তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশের পত্রিকা পড়ে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর হারিছ চৌধুরীর ছবি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তার চাচাতো ভাই ও কানাইঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। সেদিন ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন’ লিখে দেওয়া স্ট্যাটাসের পাশাপাশি হারিছের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছবি সংযুক্ত করেন তিনি। সেই স্ট্যাটাসের নিচে বিএনপি ঘরানার কেউ কেউ মন্তব্যে হারিছের সুস্থতা কামনা করেন। গত সপ্তাহে নিজের ছবির সঙ্গে হারিছের ছবি যুক্ত করে আশিক ফেসবুকে নিজের ওয়ালে আবার লেখেন- ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন’। এতে কেউ কেউ ‘ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন’ লিখে মন্তব্য করেন। তার স্ট্যাটাস কেন্দ্র করে হারিছের প্রথমে অসুস্থতার ও পরে মৃত্যুর সংবাদ ছড়ায়।
যোগাযোগ করলে বিএনপির নেতা আশিক চৌধুরী মত ও পথকে বলেন, ‘গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা যান। যে সময় তিনি মারা যান, আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলাম। চাচাতো ভাই মারা যাওয়ার বিষয়টি মুঠোফোনে জানতে পারি।’
হারিছ চৌধুরীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, তিনি শিক্ষক পরিচয়ে ঢাকায় ‘আত্মগোপন’ করেছিলেন। শারীরিক অসুস্থতায় বাসায় চিকিৎসা নিতেন বেশি, কয়েকবার হাসপাতালেও ভর্তি হন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ‘চেহারা বদলে ফেলায়’ পুলিশ তাকে চিনতে পারেনি। কীভাবে, কখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ‘চেহারায় পরিবর্তন’ আনেন, এ বিষয়ে পরিবার বিস্তারিত জানাতে পারেনি।
সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলার দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গ্রামে হারিছ চৌধুরীর বাড়ি। গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকেন না। ২০০৭ সালের শুরুতে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে স্ত্রী জোসনা আরা চৌধুরীকে নিয়ে তিনি একবার সেখানে যান। ঢাকায় বিএনপি নেতাদের বাসভবনে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলে। একপর্যায়ে হারিছের গ্রামের বাড়িতেও অভিযান হয়। ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি থেকে তিনি পলাতক ছিলেন