নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন দেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতা, অনিয়ম-অস্বচ্ছতা নির্বাচন কমিশনকে আরও প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল। আমরা বরাবরই গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আসছি। কিন্তু নির্বাচনকালীন প্রধান নিয়ামক শক্তি নির্বাচন কমিশন তো বটেই; সরকারের দায়িত্বশীল অনেকেই অনিয়ম-অস্বচ্ছতার অভিযোগ অস্বীকার করে অনিয়মের পক্ষে উল্টো সাফাই গাচ্ছিলেন! এমতাবস্থায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নমুক্ত করার চ্যালেঞ্জটি আরও জোরালোভাবে নির্বাচন কমিশনের সামনে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের মেয়াদের অন্তিমে এসে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারল- তারা চাইলে ভালো কিংবা দৃষ্টান্তযোগ্য নির্বাচন করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। অনিয়মের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন তাদের মেয়াদকালে সর্বোত্তম।
কে এম নূরুল হুদা কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর তাদের মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করার মধ্য দিয়ে এও প্রমাণ করল- আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, এর যথাযথভাবে প্রতিপালনে দায়িত্বশীলরা দায়বদ্ধ ও নীতিনিষ্ঠ থাকলে গণতন্ত্রের উৎসব হিসেবে বিবেচিত ভোট পর্ব কিংবা নির্বাচন কলুষতামুক্ত করা সম্ভব। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচারের শুরু থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে সহিংসতা, পেশিশক্তির দাপট, কমিশনের স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়নি- এটি স্বস্তির বিষয়। আমার মনে হয়, সরকারও চেয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক চলমান বিতর্কের আগুন নিভে যাক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সুশাসন একই সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে জনঅধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না- এরও প্রমাণ মিলল এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
নির্বাচন কমিশনসহ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অন্য স্তর যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনে অংশীজনের যূথবদ্ধ প্রয়াসে ঘাটতি থাকলে স্বচ্ছ নির্বাচন যে সম্ভব নয়- এর অনেক নজির আমাদের সামনে আছে। এদেশের মানুষ ভোট দিতেই শুধু নয়; ভোট পর্বের আনুষঙ্গিক সব ব্যাপারেই আগ্রহী এবং তাদের অভিপ্রায় গণতন্ত্রের ঔজ্জ্বল্য। এর আগে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা, ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতিতে অনীহা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছিল নানা কারণে। সচেতন মানুষমাত্রেই এ কারণগুলো জানা। স্বস্তির বিষয় হলো, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ উপসর্গ দেখা যায়নি। বিজয়ী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংশ্নিষ্ট সব পক্ষকে অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাই।
সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা চাপে আছে; তাও সচেতন মানুষমাত্রেই জানা। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ডও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ। এ সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়, সরকার ও সংশ্নিষ্ট সবার টনক নড়েছে বলেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি অন্ধকারের মধ্যে আলোর রেখা হিসেবে দেখা দিতে পেরেছে। আমরা দেখেছি, ওই নির্বাচনে ইভিএম জটিলতায় ভোটারদের কিছু ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। বলা যায়, একটি ভালো নির্বাচনে এই ত্রুটি কিছুটা ছন্দপতন ঘটিয়েছে। আমরা আগেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও ভেবেচিন্তে এবং এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করার কথা বলে আসছিলাম।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক আলোচিত ভোটারের ‘খরা’ কেটেছে, তাও দৃশ্যমান। নারায়ণগঞ্জে ভোটারের সংখ্যা যতটা বেশি, সে অনুপাতে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোট পড়েনি। ভোটের প্রতি মানুষের যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছিল কিংবা ‘বিনা ভোটে নির্বাচন’ বা ‘একতরফা’ নির্বাচনের অপপ্রবণতাগুলোও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তবে কিছু ‘গায়েবি’ মামলা ও ধরপাকড়ের যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল, এগুলোর দ্রুত সুষ্ঠু সুরাহার পাশাপাশি ভালো দৃষ্টান্তটি ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে পাথেয় করে রাখা যায়, এই প্রচেষ্টা নির্বাচন কমিশন, সরকার, প্রশাসনসহ সংশ্নিষ্ট সবার থাকুক।
পুনর্বার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পুনঃপ্রকাশ ঘটল। এবারও তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ছিলেন একজন জনপ্রিয় ও শক্তিশালী প্রার্থী। তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। তিনি তার অবস্থান থেকে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা নির্বাচন কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত। যেহেতু তারা শেষ পর্যন্ত একটা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছে, সেহেতু এ সংক্রান্ত বাকি সব কাজও তারা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করুক; এ প্রত্যাশা আমাদের থাকবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দায়িত্বশীল প্রতিটি মহল এও অনুধাবন করুক; ব্যক্তি বা মহলবিশেষের ব্যর্থতা-স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কীভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ নির্বাচন ব্যবস্থার ধস নেমেছিল। তাদের প্রত্যেকের আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন শুধু নিজেদের শুদ্ধির জন্যই নয়; সার্বিক প্রয়োজনের নিরিখেই। সরকারি দলসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই সত্যও অনুধাবন করুক- স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন, দক্ষ-যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া জরুরি। বাহুবল, অস্ত্রবল কিংবা যে কোনো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত তারাই করেন, যাদের জনভিত্তি নেই এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যাদের অঙ্গভূষণ হয়ে আছে।
শান্তিপ্রিয় মানুষ নির্মোহ, দায়বদ্ধ, অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সক্ষম এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদেরই পছন্দ করেন- ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পুনর্বার বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই সত্যগুলোও আমাদের সামনে উঠে এলো। আমরা আশা করব, পরের ধাপের ইউপি নির্বাচনসহ সার্বিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থা স্বচ্ছ করার জন্য সুনীতির দীক্ষা দায়িত্বশীলরা বিসর্জন দেবেন না। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষমতার জোরে কেড়ে নেওয়ার এখতিয়ার কারোরই নেই। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা প্রচারাভিযানের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন ছিল না। দলের ভেতরেই নানারকম দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু ডা. আইভী সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিজয়ী হতে পেরেছেন তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও কর্মদক্ষতার কারণে। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টি যদি আমলে রাখে তাহলে নির্বাচনে ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসার ক্ষেত্রে তা অনেকটাই হবে সহায়ক।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত কিংবা স্বচ্ছ হওয়ার ওপর সরকারের ভাবমূর্তি অনেকাংশে নির্ভর করছিল। দেশে যখন চলেছে প্রায় একমুখী কিংবা এক ধারার রাজনীতি এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি স্থানীয় সরকারসহ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন বর্জন করে চলেছে; তখন সরকারের এটুকু স্পষ্ট করা জরুরি ছিল- তারা অস্বচ্ছতার চাদরে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াকে আর ঢেকে রাখতে চায় না। এখন প্রশ্ন হলো- নির্বাচন কমিশন, সরকার কিংবা প্রশাসনের মধ্যে এই উপলব্ধি সত্যিকার অর্থেই কতটা গভীরভাবে প্রথিত হয়েছে। এর জন্য আমরা তাকিয়ে আছি সামনের ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্য নির্বাচনের দিকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি পথরেখা সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু এখানেই পুরোপুরি স্বস্তি খোঁজার অবকাশ নেই। আমাদের স্মরণে আছে, ২০১৩ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলই ক্ষমতায় ছিল এবং তখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীপক্ষ জয়ী হয়েছিল। তখন দেশে পুনর্বার নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। অনেকেই তখন বলেছিলেন, সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছে- দলীয় সরকারের অধীনেও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন সম্ভব। আমরাও আস্থা রেখেছিলাম নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ওপর। তারা চাইলে তা সম্ভব। কিন্তু আস্থা ধসে পড়তে খুব সময় লাগেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি।
একটি ভালো দৃষ্টান্ত যেহেতু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পাওয়া গেল, সেহেতু স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জনপ্রত্যাশা পূরণের কাজটি শুরু করা দরকার এখান থেকেই। ভালো কিংবা খারাপ এ দুই অভিজ্ঞতা আমলে রেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ একটি বিকশিত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি তা করতে হবে জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়োজনে; দলীয় বিবেচনায় নয়।
এম হাফিজ উদ্দিন খান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা