টাকার উৎস ও পাঠানোর পথ বৈধ কী না, তথ্য নেই কারো কাছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়নি।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য’ যুক্তরাজ্যের কাছে সম্প্রতি আবেদন করে ‘গারনিকা- ৩৭’ নামের একটি সংগঠন। এতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ছয়জনসহ ‘ৱ্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের’ (র্যাব) দশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ’ করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ’ কীসের ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেটা বলছে না সংগঠনটি।
দেশের কারো বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা আরোপে’ যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আবেদন বলে বিতর্কিত সংগঠন গারনিকা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করছে। যুক্তরাজ্যের সমালোচিত এ সংগঠনের দাবি, ‘এ দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের আর্থিক সমর্থন নিয়ে তারা আবেদন করেনি। এটা অব্যবসায়িক মনোভাব থেকে করা হয়।’ সংগঠনটির এ দাবি কিছুতেই সত্য নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
সংগঠনটির কর্তাব্যক্তি টোবি ক্যাডম্যান এ দেশের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে’ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জামায়াতের ‘আইনি প্রতিনিধি’। জামায়াতের লবিংয়ে বিপুল টাকার বিনিময়ে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ’ করতে প্রভাবশালী দেশগুলােতে নানা তৎপরতা চালিয়ে আসছেন ঢাকায় আদালত গঠিত হওয়ার পর থেকে।
ব্রিটিশ আইনজীবী ক্যাডম্যান বিএনপির নিয়োজিত লবিস্ট হিসেবে গত একযুগের মধ্যে কয়েকবার চুক্তিবদ্ধ হন, এর প্রমাণ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশিত বিভিন্ন নথি। তিনি ২০১৫ সালে বিএনপির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাকিনগাম্প স্ট্রস হাওয়ার অ্যান্ড ফেল্ড এলএলপি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন প্রতি মাসে এক লাখ ডলারে (৮০ লাখ টাকা)।
মত ও পথের অনুসন্ধান বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার বছর দুয়েক পর থেকে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের লক্ষ্যে’ লবিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। দল দুটি ক্ষমতায় যেতে বিদেশি সরকারের ‘সমর্থনের লক্ষ্যে’ একের পর এক লবিস্ট নিয়োগ করে আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে দলগুলোর লবিং কার্যক্রম বাড়ে। ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো একই দেশে বেশ কয়েকটি লবিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করে।
আগামী বছর অনুষ্ঠেয় পরবর্তী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত লবিং তৎপরতা বাড়াচ্ছে বলে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য এসেছে। গতকাল সোমবার সংসদে দলগুলোর লবিস্ট নিয়োগে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি আলোচিত হয়।
লবিস্ট নিয়োগে দল দুটির গত একযুগে মোট কতো টাকা খরচ হয়েছে, এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে তথ্য নেই। এসব টাকার উৎস কী, লবিংয়ের জন্য টাকা বৈধ, নাকি অবৈধ পথে বিদেশে দলগুলো পাঠিয়েছে- এ বিষয়েও তথ্য নেই। দল দুটি বিদেশে লবিংয়ের বিষয়গুলোতে ‘গোপনীয়তার নীতি’ অনুসরণ করে আসছে। দেশে জবাবদিহির ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় ‘গোপনীয়তা রক্ষা’ সম্ভব হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
তথ্যমতে, একযুগ ধরে বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট নিয়োগের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ছিল- একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত ও বিএনপির নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা, দেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা দেশগুলোর চাপ তৈরি, আর্ন্তজাতিক সহায়তা বন্ধ করে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটানো, দুর্নীতির মামলার রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস ঠেকানো এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি। এতো টাকা খরচে লবিস্ট নিয়োগ করে উদ্দেশ্য কতোটা পূরণ হয়েছে, এর কোনো মূল্যায়ন দল দুটির কাছে নেই।
র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর গত বছরের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ বিএনপি-জামায়াতের লবিংয়ে হয় বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন। তবে দল হিসেবে গত একযুগের মধ্যে আওয়ামী লীগ নিজের কার্যক্রম তুলে ধরতে বিদেশে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়নি। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে লবিস্ট নিয়োগ উন্নত অনেক দেশে স্বীকৃত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তা করে থাকে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এটা করলেও এ বিষয়ে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। বিদেশি লবিং সংস্থাগুলো চুক্তির আগে দলগুলোর টাকার উৎস বৈধ কী না, তা খতিয়ে দেখে না।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট ফার্মের পেছনে তিন বছরে বিএনপি দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) খরচ করে, এ তথ্য গত ১৭ জানুয়ারি সংসদে দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত গত পাঁচ বছরে যত লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে, তার প্রতিটির যোগাযোগের ঠিকানা আছে, প্রতিটির টাকাপয়সার হিসাব আছে। কে দিয়েছেন, কোন অ্যাকাউন্টে নিয়েছেন, সবকিছু আছে।’
বিদেশে ‘সহানুভূতি পাওয়ার লক্ষ্যে’ বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ দেয়। এ জন্য সব মিলিয়ে দলটির খরচ হয় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের জন্য ‘ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিএনপি নিয়োগ দেয় মাসিক ৩৫ হাজার ডলারে (২৮ লাখ টাকা)। ‘করভিস কমিউনিকেশনস’, ‘এলএলসি;র সঙ্গে ২০০৭ সালে বিএনপি চুক্তিবদ্ধ হয়।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ গত ৭ জানুয়ারি ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, ‘সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ রকম আরও অনেকের নাম আসবে।’ কোন সূত্র থেকে এ তথ্য পান, বা তথ্যটির ভিত্তি কী- এ বিষয়ে বিএনপির নেতা কিছু বলেননি।
হাফিজ উদ্দিনের কথিত ওই দাবি নাকচ করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়নি। এরপর গত দশ-বারো দিনের মধ্যে তিনি নিজের ‘তথ্যে বিভ্রাট’ দূর করতে কোনো বক্তব্য, বা ভুল সংশোধন করে বিবৃতি দেননি।
সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিএনপি-জামায়াতের নিয়োজিত লবিস্টরা নতুন করে দেশের আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য’ দেশ দুটির সরকারের কোনো কোনো বিভাগে আবেদন করার বিষয়টি হাফিজ অনুষ্ঠানে ‘মুখ ফস্কে’ বলে ফেলেন। এর জন্য তাকে বিএনপির পক্ষ থেকে ‘মৌখিকভাবে সতর্ক’ করা হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করলে তিনি মত ও পথের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ‘মানবাধিকার ও আইনগত ত্রুটির’ প্রশ্ন তুলে লবিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে লবিস্ট হিসেবে জামায়াত নিয়োগ করে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’কে। ২০১৬ সালে ‘ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ ও ‘ক্লোক রুম অ্যাডভাইজার্স’র সঙ্গে একই উদ্দেশ্যে চুক্তিবদ্ধ হয় দলটি।