চলতি বছরেই যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিচার

হাসান শান্তনু

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সংগঠন বা রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বিচার কার্যক্রম চলতি বছরেই শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংগঠনটির বিচারের লক্ষ্যে আইন সংশোধন করে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন ও তা জাতীয় সংসদে পাস করানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হচ্ছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে আদালতে বিচারাধীন থাকা মামলা আইনি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে আন্তরিক হতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র মত ও পথকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, দল হিসেবে জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য বেশ আগেই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ আইন সংশোধন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংগঠনটির যুদ্ধাপরাধের তদন্ত কার্যক্রমও শেষ হয়। এসব উদ্যেগ প্রত্যাশিত গতি পায়নি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনায় উপস্থাপনের জন্য ওই সংশোধনী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়বার আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আনিসুল হকও সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার শুরুর জন্য আবারো আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

universel cardiac hospital

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত গত ২৪ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। ওই রায়ের পর প্রসিকিউটররা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের পথ খুলতে আলোচনা চলছে, খুব শিগগিরই তা পরিষ্কার হবে। জামায়াতের শীর্ষনেতাদের বিচারকালে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত কয়েকবার রায় দেন, এটাকে যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র মত ও পথকে বলে, জাতীয় সংসদের এবারের অধিবেশনে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া পাশের বিষয়ে ব্যস্ততা আছে। এরপরের কোনো অধিবেশনে জামায়াতের বিচার করতে সংশোধিত আইন পাশ হবে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকে ছাড় দেবে না। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংগঠনটির বিচার হবে।

জানা যায়, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে সরকারের মনোভাব সবসময়ই ইতিবাচক। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ায় বিষয়টা বিচারাধীন হওয়ায় আদালতের রায় অনুযায়ীই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারে। এতে যে কোনো ধরনের বিতর্ক এড়ানো যাবে। বিচারাধীন মামলাটি তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক হওয়ার কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তিনজন নেতা বলেন, অপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিচার এখনো হয়নি। তবে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে উল্লেখ ছিল একাত্তরের নরঘাতক ও ইসলাম ধর্মের নামে মানবতাবিরোধীদের বিচারের কথা। দেশ-বিদেশের নানা বিরোধিতা উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করে তা কার্যকর করে আওয়ামী লীগের সরকার। উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে গত ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপনও জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে নিজেদের দলীয় প্রতীকে কোনো নির্বাচন করতে পারছে না দলটি।

যোগাযোগ করলে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এ বিষয়ে মত ও পথকে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া একটা পর্যায়ে থেমে যাওয়ার পেছনে সাবেক এক প্রধান বিচারপতির বিতর্কিত ভূমিকা ছিল। সংগঠনটির বিচার অবশ্যই করতে হবে, কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। একইসঙ্গে আলবদর, আলশামসসহ যুদ্ধাপরাধী অন্য সংগঠনগুলোরও বিচার করতে হবে।’

তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী ব্যক্তির বিচার করেন। ওই আইনে সংগঠন ও দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের কোনো ধারার উল্লেখ নেই। তাই আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুযায়ী দেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। সংগঠনটি ফতোয়া দিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ে গণহত্যা ঘটানোসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কাণ্ডের দায়ে পাকিস্তানে দুইবার এবং ভারতে চারবার নিষিদ্ধ হয়।

দেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জামায়াতসহ ধর্মপন্থি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে দলটি। দলটির দুজনকে মন্ত্রিসভায় রাখেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দুজনেরই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হয় আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে।

শেয়ার করুন