বিশ্বব্যাংকের নতুন পূর্বাভাসের চ্যালেঞ্জ

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরও উন্নতির পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থার সর্বশেষ গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেকটাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আমাদের স্মরণে আছে, এর আগে গত বছর জুনে বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, একই অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এবার তারা তাদের প্রতিবেদনে এই আশাবাদও ব্যক্ত করেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা পরের অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে। তাদের মতে, সেবা খাতের কর্মকাণ্ড ও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি বাড়ার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরও কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ওই মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণে আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারার যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা যথার্থই মনে করি। আমরা যদি নতুন করে সৃষ্ট করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সবকিছু সঠিকভাবে চালাতে কিংবা ধাক্কাটা সামাল দিতে পারি, তাহলে এ আশাবাদের পূর্ণতা হয়তো মিলবে।

দীর্ঘ সময় ধরে চলমান করোনা দুর্যোগ-উত্তর পরিস্থিতিতে দেশে প্রায় সর্বক্ষেত্রে নতুন উদ্যমে যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল তা আশাব্যঞ্জক। অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যেভাবে কাজ শুরু করে, এ ক্ষেত্রে নতুন করে কিছুটা হলেও উদ্বেগের রেখা টেনে দিয়েছে ফের করোনার সংক্রমণ বেড়ে চলা এবং এর নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’-এর চোখ রাঙানি। কয়েক মাস আগে এই কলামেই লিখেছিলাম, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বটে, কিন্তু তাতে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। বারবার ধরন পরিবর্তন করে চলা করোনা যে কোনো সময় নতুন রূপে দেখা দিতে পারে এবং এ জন্য অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। জনস্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকসহ সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সৃষ্ট অবস্থা মোকাবিলায় অধিক সতর্কতার তাগিদ দিচ্ছে বিদ্যমান পরিস্থিতি। জনস্বাস্থ্যের জন্য তো বটেই, অর্থনীতির জন্যও করোনার পুনঃসংক্রমণ বড় চ্যালেঞ্জ দাঁড় করিয়েছে। কাজেই ফের যাতে অর্থনৈতিক খাতগুলোতে বড় কোনো বিরূপ অভিঘাত না লাগে, এ জন্য অত্যন্ত জরুরি সরকারের সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নিবিড় করা।

বিশ্বব্যাংক আমাদের সমকাতারের দেশগুলোর পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্নেষণ করে তাদের যে মূল্যায়ন-পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে, তা আমাদের নীতিনির্ধারকদের আমলে নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। দেশের বড় শিল্প অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে, তা সত্য। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভূমিকাও কম নয়। তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র যথেষ্টই বিস্তৃত, যদিও করোনাকালে তা অনেকটা সংকুচিত। গত করোনা দুর্যোগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় অভিঘাত লেগেছে। ওই ধাক্কা সামাল দেওয়া অনেক উদ্যোক্তার পক্ষেই এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সামনে সমস্যা অনেক। তাদের প্রণোদনা থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তিসহ নানা ক্ষেত্রেই পড়তে হয় প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার মধ্যে। বড় শিল্পের দিকে যেমন নজর রাখতে হবে, সমভাবেই নজর রাখতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকেও। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিমালা আরও সুবিন্যস্ত করা দরকার। এসব ব্যাপারে সমতার বিষয়টিও আমলে রাখা প্রয়োজন। ন্যায্যতা-সমতা অর্থনৈতিক-সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি তো শুধু একটি-দুটি বিষয়ের ওপর নয়; অনেক কিছুর ওপর ভর করেই হয় বিকশিত।

তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের শ্রমঘন অন্যতম বড় খাত। এর বিকাশ যত হবে অর্থনীতিতে খাতটির ভূমিকা তত বেশি দৃশ্যমান হতে থাকবে। কাজেই এ শিল্পের এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও মসৃণ করার ওপর বিশেষ নজর দাবি রাখে। পাশাপাশি নজর আরও নিবিড় করা জরুরি কৃষি খাতেও। কৃষি আমাদের অর্থনীতির বড় জোগানদার। গতবার যেমন, এবারও তেমনি কৃষি খাতে উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে শুধু কৃষিই নয়, এর সঙ্গে ফিশারি, হ্যাচারি, পোলট্রিসহ আত্মকর্মসংস্থানমূলক অন্যান্য ক্ষেত্রেও গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ বড় শিল্প থেকে শুরু করে আত্মকর্মসংস্থানমূলক সব কর্মকাণ্ড ও ব্যবসার পথ নিস্কণ্টক করা জরুরি। কৃষি খাতে ধান-গম চাষাবাদের পাশাপাশি অন্য কৃষিপণ্য উৎপাদনেও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে আরও পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দরকার। বর্গাচাষি কিংবা প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সহায়তার হাত প্রসারিত করা জরুরি শুধু তাদের কল্যাণ কিংবা প্রয়োজনেই নয়; সার্বিকভাবে অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্যই।

বড় কিংবা ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সহায়ক সর্বক্ষেত্রেই ঋণদানে বাছবিচারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ঋণের সঠিক ব্যবহার, সময়মতো ঋণ পরিশোধ, প্রক্রিয়াগত জটিলতা নিরসন ইত্যাদি বিষয়েও সতর্কতা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষত হয়ে আছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচারের প্রসঙ্গও আসে। এসব ব্যাপারে কথা হয় যত, কাজের কাজ হয় না তত। ব্যাংক খাতের যে বিবর্ণ চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসছে, তা নতুন ব্যাধি নয়। ব্যাংক খাতের সংস্কার একই সঙ্গে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। এসবই অর্থনীতি বিকাশের মাধ্যম কিংবা সহায়ক শক্তি। ব্যাংক খাত প্রত্যাশার চেয়ে পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। বরং মনোযোগ বাড়াতে হবে- কীভাবে সব নেতিবাচকতার নিরসন করে ইতিবাচকতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা যায়, যাতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আরও এগিয়ে যায়।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের চেয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। এখন দেশে যে বিনিয়োগ আছে তা ৩২ শতাংশের মতো। বিনিয়োগ যদি ৩৭-৩৮ শতাংশ নিয়ে যাওয়া যায় তবে এর বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হবে। সর্বাগ্রে দরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বিঘ্ন করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নিরসন, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক সব সেবা পাওয়ার পথ ও প্রক্রিয়া সহজ এবং নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা রকম জটিলতা-দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হতে হয় উদ্যোক্তাদের। এসবের নিরসন না করে শুধু বিনিয়োগের আহ্বান জানালেই কি সুফল মিলবে? দুর্নীতিও উন্নয়ন-অগ্রগতির বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ করার জন্য ভালো জায়গা, তা বিদেশিরাও জানেন। এখানে শ্রমের মূল্য তুলনামূলক কম; শ্রমিকরা কাজের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান; লাভের সম্ভাবনা বেশি- এই বার্তাগুলো তাদের কাছে আছে। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়।

রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে এবং পাচারকৃত অর্থের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থ পাচারের ক্ষত ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার সঠিক ব্যবহার না করে পাচার করে দিচ্ছেন! এক কথায়, সর্বক্ষেত্রে চাই সুশাসন। সুশাসন নিশ্চিত হলে অর্থ পাচারের মতো আরও অনেক অপরাধের রাশ টেনে ধরা যাবে সহজেই। বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কিংবা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দূর করতেই হবে। এসব অর্থনীতি তো বটেই, সামগ্রিকভাবে সমাজের বিকাশের জন্য বড় অন্তরায়। অপরাধের উৎস বন্ধ করতে হবে। বাজারে তুঘলকি কাণ্ড চলছেই। অর্থনীতির কোনো ধ্রুপদি নিয়মই যেন আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে সচল নয়। যার যেমন ইচ্ছা তেমন চালাচ্ছে। তাতে ব্যক্তির পকেট স্ম্ফীত হচ্ছে, সমষ্টির অকল্যাণের পথ চওড়া হচ্ছে। কালোবাজারিদের অপকৌশল অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অতিমারির কারণে প্রবৃদ্ধির ধারা ব্যাহত হওয়ার নানা অভিজ্ঞতা যেহেতু আমাদের রয়েছে এবং দারিদ্র্য বেড়েছে, সেহেতু ওই অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে নতুন প্রেক্ষাপট মোকাবিলায় পরিকল্পিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে নতুন ছক কষে। ধারাবাহিক এই সরকারের বর্তমান মেয়াদের তিন বছরে সব সূচকেই অগ্রগতি লক্ষণীয়। উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে, তা অসত্য নয়; কিন্তু সুশাসন নিয়ে যে প্রশ্ন আছে তা দূর করতে হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের রয়েছে ‘শূন্য সহিষুষ্ণতা’র অঙ্গীকার। কিন্তু শুধু অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে নির্মোহ ও কঠোর হতেই হবে। দুর্নীতি নির্মূল অর্থনীতির বিকাশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অন্যায়কারী, অপরাধীর শাস্তি দৃশ্যমান করা চাই। রাজনৈতিক অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতাও অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে- এমন উপসর্গ অর্থনীতির ওপর কী বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তির অভাবও যে অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ, তাও যেন আমরা ভুলে না যাই। বৈষম্য জিইয়ে আছে, বরং তা আরও বাড়ছে। অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয় বেড়েছে; কিন্তু সবাই কি এর সুফল পাচ্ছেন? সমতা নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। অর্থনীতির জন্যও তা ভালো হবে না।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ :বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

শেয়ার করুন