নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২০ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেন তিনি। ক্ষমতায় এসেই পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রেখে যাওয়া বিভক্ত জাতি, করোনা মহামারি ও অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। আজ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দায়িত্ব নেওয়ার একবছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে গত একবছরে তার সফলতা-ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরছে আর্ন্তজাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো।
এএফপির এক প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা দ্রুত নিচের দিকে নামছে। দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মাথায় তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করল। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা বাইডেনের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।
প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিন সামনে রেখে ‘এবিসি নিউজ’ ও ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’–এর পরিচালিত যৌথ জরিপে বলা হয়, বাইডেনের ১০০ দিনের কাজ সমর্থন করেছেন ৫২ শতাংশ মার্কিন নাগরিক। সেই হিসাবে, গত ১০০ বছরে দায়িত্ব পালন করা মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা তৃতীয় সর্বনিম্নে। ১৮ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে এক হাজার ৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন নাগরিকের ওপর টেলিফোনে জরিপটি চালানো হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদন মতে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে যারা প্রায় চিরকাল ভোট দিয়ে এসেছেন, সেই কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, নারী ও তরুণ জনগোষ্ঠী – তারাও বাইডেনের প্রেসিডেন্সি নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ। তারা বলেন- বাইডেনের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না, অর্থবহ কোনো পরিবর্তন সমাজে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সব মার্কিন প্র্রেসিডেন্টই কিছুটা জনপ্রিয়তা হারান। এটা আগেও অনেকবার দেখা গেছে। বাইডেনের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়ে থাকতে পারে।
তবে আসল প্রশ্ন হলো- ২০২২ সালে হাউজ ও সেনেটের আসনগুলোর যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে, এর আগে বাইডেন তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পাবেন কী না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্থির সময় ভুলে বাইডেনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তা মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। ফলে ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ দেশটির উদারনৈতিক মহল দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
যেসব প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন জো বাইডেন, সেগুলোর বেশিরভাগই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র সুসংহত, করোনা মহামারির নিয়ন্ত্রণ, বর্ণবাদের মূলোৎপাটন এবং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন বাইডেন। ২০২১ সালে এগুলোর সমাধানে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। ২০২২ সালেও তাকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
ট্রাম্প করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকাদান জোরদার কর্মসূচির বিপক্ষে থাকলেও বাইডেন এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই মহামারি মোকাবিলায় দ্রুত সবাইকে টিকা দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পরে ‘ডেলটা’ ধরনে বিপর্যস্ত হয় দেশটি। সম্প্রতি সেখানে ওমিক্রন ধরনের প্রভাবে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে। একদিনে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোগী দেখেছে দেশটি।
সব ধরনের কঠোর পদক্ষেপের পরও দেশটির শতভাগ মানুষকে টিকা দিতে পারেনি বাইডেন প্রশাসন। সবাইকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টার অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়েও কাজ হয়নি। দেশটির একটি বৃহৎ অংশ টিকা নিতে অস্বীকার করেছে।
বাইডেনের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক। দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব রুখতে তিনি এ পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ঘোষণা করেছেন বাইডেন। জলবায়ু ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়নের বাজেট দিয়েছেন তিনি। গত বছর তিনি ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র রেকর্ড অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে। এরপরই এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি।
গণতন্ত্র ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন বাইডেন। মধ্যপন্থি এ নেতা ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি স্থগিত করেছিলেন। তবে আদালত তার স্থগিতাদেশ বাতিল করে দিয়েছেন। ভোটাধিকার বিল করা নিয়ে কংগ্রেসে তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। অস্ত্র আইন ও বর্ণবাদ নিয়েও তাদের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। বাইডেন কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি সংবলিত আইনও সংশোধন করাতে পারেননি। প্রতিশ্রুতিতে বাইডেন বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে বিভক্তি বেড়েছে।
বাইডেন ক্ষমতায় এসে প্রথমে বলেছিলেন, বিশ্বের নেতৃত্বে ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। বহু সংস্থার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ সংক্রান্ত সক্ষমতা হ্রাস করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো ও প্রভাবশালী মিত্র ইউরোপ ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করেছে ওয়াশিংটন। এ ছাড়া আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন তিনি। তবে চীনকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতির বাইরে গিয়ে কূটনীতির ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।