শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে র‍্যাবের অংশ নেওয়ায় প্রভাব পড়বে?

হাসান শান্তনু

‘র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের’ (র‍্যাব) সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালকসহ সাতজনের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তরের গত ডিসেম্বর মাসে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মোটা দাগে একটি প্রশ্ন আসছে। সেটা হলো- ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ’ সংস্থাটির সদস্যদের কী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে? প্রশ্নটি যখন ঘুরেফিরে আসছিল, ঠিক তখনই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ‘র‍্যাবকে বাদ দেওয়ার আহবান জানিয়ে’ ১২টি মানবাধিকার সংস্থার চিঠির তথ্য সামনে আসে।

আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ওই চিঠি জাতিসংঘের কাছে পাঠায় ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর। দুইমাসের বেশি সময়ের মধ্যেও শান্তিরক্ষা কর্মসূচি থেকে ওই চিঠির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি সংস্থাগুলোকে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি শাখায় তাদের চিঠি ‘গুরুত্ব না পাওয়ায়’ ২০ জানুয়ারি সংস্থাগুলো চিঠির প্রসঙ্গটি সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ, প্রচার করে। সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে থাকা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ তথ্যটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রচার করে।

universel cardiac hospital

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো সংস্থার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষ ও পরিক্ষিত সদস্যদেরকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাধারণত নেওয়া হয় না। বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের সরকারের মধ্যে। র‍্যাব ও সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির কূটনৈতিকভাবে সমাধানের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে কী কী প্রভাব পড়তে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের উপ-মুখপাত্র রাভিনা শ্যামদাসানি গত মাসেই আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন- ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলবে না। শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের সরকার মনোনয়ন দিলে, তাকে যাচাই-বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার র‌্যাব সদস্যদের শান্তি মিশন থেকে প্রত্যাহারের দাবি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমাদের কাছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবৃতির কোনো মূল্য নেই। কারণ, সরকার একাধিকবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা আমাদের বক্তব্য শুনে অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা কথা রাখেনি।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পুরোনো। বিএনপি-জামায়াতের সরকারের আমলে র‍্যাব গঠিত হওয়ার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একটি তারবার্তা ফাঁস হয়। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা সে সময় লেখেন, ২০০৭ সালের নির্বাচনসহ মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে র‍্যাবের কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে পারে। ‘পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’-এ মৃতের সংখ্যা বাড়ছে এবং র‍্যাব ক্রসফায়ারে হত্যার সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে যাচ্ছে’ ছিল ওই তারবার্তার শিরোনাম।

ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ফাঁস হওয়া তারবার্তায় ২০০৭ সালের যে সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ আছে, নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনা অনুযায়ী একতরফা ও বহুল বিতর্কিত নির্বাচনটি ওই বছরের ২২ জানুয়ারি হওয়ার কথা ছিল। র‍্যাব কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশের এতো বছর পর এ নিষেধাজ্ঞা কেন? যে কারণেই নিষেধাজ্ঞা আসুক, তারা চান কূটনৈতিকভাবে এর সমাধান হোক।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সামনের সারিতে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের ভূমিকার কথা সারাবিশ্বে প্রশংসিত। ২০২০ সালেও বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। ওই বছর বিভিন্ন বাহিনী থেকে ছয় হাজার ৭৩১জন সদস্য পাঠানো হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘে পাঠানো চিঠিতে যেসব সংস্থার স্বাক্ষর আছে, সেগুলে হলো- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ান্সেস, এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড এলায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস, দ্য এডভোকেটস ফর হিউম্যান রাইটস ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার।

শেয়ার করুন