লবিস্ট নিয়োগ বিতর্কে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে?

হাসান শান্তনু

বিএনপি-জামায়াতের বিদেশে লবিস্ট নিয়োগে টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার। বিষয়গুলোর তদন্ত করতে সংসদে দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েক সংসদ সদস্য। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকারের অভিযোগ ও বক্তব্যের যৌক্তিক জবাব না দিয়ে বিএনপি অভিযোগ করে- ‘আওয়ামী লীগই বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের নামে জনগণের অর্থ ব্যয় করছে।’ এর ‘সুষ্ঠু তদন্ত’ দাবি করে বিএনপি। বিদেশে লবিং এখন তাই দেশের রাজনীতিতে আলোচিত ইস্যু।

দেশের অন্যান্য খবর পেছনে ফেলে সামনে চলে এসেছে লবিস্ট বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুরু হয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ি। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, তর্ক-বিতর্ক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের লবিং ফার্মের সঙ্গে কোনো দেশের রাজনৈতিক দল চুক্তিবদ্ধ হলে, এ তথ্য লুকানোর সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী মাসিক কতো টাকার ভিত্তিতে ও কতোদিনের জন্য চুক্তি, তা জানাতে হয় দেশটির সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। লবিং ফার্মগুলোর এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশও করে থাকে।

universel cardiac hospital

দল হিসেবে গত একযুগের মধ্যে আওয়ামী লীগ নিজের কার্যক্রম তুলে ধরতে বিদেশে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, এমন তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নথি থেকে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯৫ সালের ‘লবিয়িং ডিসক্লোজার’ আইন মেনে লবিং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশ করা তথ্য বলছে, উল্লেখিত সময়ের মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশটিতে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার বছর দুয়েক পর থেকে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের লক্ষ্যে’ লবিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসছে। দল দুটি ক্ষমতায় যেতে বিদেশি সরকারের ‘সমর্থনের লক্ষ্যে’ একের পর এক লবিস্ট নিয়োগ করে আসছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে দলগুলোর লবিং কার্যক্রম বাড়ে। ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো একই দেশে বেশ কয়েকটি লবিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় পরবর্তী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত লবিং তৎপরতা বাড়াচ্ছে বলে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য এসেছে। এ ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত আপাতত বেকায়কায় থাকলেও দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেলায় পিছিয়ে নেই।

লবিস্ট নিয়োগে বিএনপি-জামায়াতের গত একযুগে মোট কতো টাকা খরচ হয়েছে, এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে তথ্য নেই। এসব টাকার উৎস কী, লবিংয়ের জন্য টাকা বৈধ, নাকি অবৈধ পথে বিদেশে দলগুলো পাঠিয়েছে- এ বিষয়েও তথ্য নেই। দল দুটি বিদেশে লবিংয়ের বিষয়গুলোতে ‘গোপনীয়তার নীতি’ অনুসরণ করে আসছে। দেশে জবাবদিহির ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় ‘গোপনীয়তা রক্ষা’ সম্ভব হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিই বিএনপি অস্বীকার করছে কিভাবে? অস্বীকার করলে কি তথ্য মিথ্যা হয়ে যায়?

সরকার লবিস্ট নিয়োগের যে অভিযোগ বিএনপি করছে, এর জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সরকার লবিস্ট নিয়োগ করেনি। জনসংযোগের (পিআর) জন্য পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে। এর জন্য প্রতি মাসে সরকারকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার দিতে হচ্ছে।’ তাছাড়া রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে লবিস্ট নিয়োগ উন্নত অনেক দেশে স্বীকৃত। সরকার তা করলে হিসাবের তথ্য-প্রমাণ থাকে। দেশের বিভিন্ন সরকারের বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের চর্চা চলে আসছে অনেক বছর ধরে।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এইচ এম এরশাদের সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে। ক্ষমতায় থাকাকালে এরশাদের পাচার করা দশ বিলিয়ন ডলার খুঁজে বের করতে তাঁর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দেয় বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। তখন ‘ফেডারেল ব্যুরো ইনভেগেস্টনের’ (ফেয়ার ফ্যাক্স) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সরকার। লবিস্ট নিয়োগে প্রচুর টাকা খরচ করা হলেও ফেয়ার ফ্যাক্স এরশাদের ‘পাচার করা টাকার’ হদিস দিতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত সরকারও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দেয়।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তা করে থাকে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এটা করলেও এ বিষয়ে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। বিদেশি লবিং সংস্থাগুলো চুক্তির আগে দলগুলোর টাকার উৎস বৈধ কী না, তা খতিয়ে দেখে না। যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট ফার্মের পেছনে তিন বছরে বিএনপি দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) খরচ করে, এ তথ্য গত ১৭ জানুয়ারি সংসদে দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

বিদেশে ‘সহানুভূতি পাওয়ার লক্ষ্যে’ বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ দেয়। এ জন্য সব মিলিয়ে দলটির খরচ হয় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের জন্য ‘ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিএনপি নিয়োগ দেয় মাসিক ৩৫ হাজার ডলারে (২৮ লাখ টাকা)। ‘করভিস কমিউনিকেশনস’, ‘এলএলসি;র সঙ্গে ২০০৭ সালে বিএনপি চুক্তিবদ্ধ হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে ‘মানবাধিকার ও আইনগত ত্রুটির’ প্রশ্ন তুলে লবিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে লবিস্ট হিসেবে জামায়াত নিয়োগ করে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’কে। ২০১৬ সালে ‘ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ ও ‘ক্লোক রুম অ্যাডভাইজার্স’র সঙ্গে একই উদ্দেশ্যে চুক্তিবদ্ধ হয় দলটি।

শেয়ার করুন