সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিল বা খসড়া আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত করেছে সংসদীয় কমিটি। তবে এর দুটি ধারায় পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। চলতি অধিবেশনেই এটি পাসের সুপারিশ করবে কমিটি।
সোমবার (২৪ জানুয়ারি) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৮তম বৈঠকে এটি চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠক হয় কমিটির সভাপতি মো. শহীদুজ্জামান সরকারের সভাপতিত্বে।
বৈঠকে কমিটির সদস্য ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান, মো. শামসুল হক টুকু, মো. আব্দুল মজিদ খান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, রুমিন ফারহানা এবং সেলিম আলতাফ জর্জ অংশ নেন।
যে পরিবর্তনের সুপারিশ
সংসদে উত্থাপিত বিলে সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা সংক্রান্ত ৫(গ) ধারায় বলা আছে, সিইসি ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এই ধারায় সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
আর অযোগ্যতার ক্ষেত্রে ৬ (ঘ) ধারায় বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না।
এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে শুধু কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছে কমিটি। অর্থাৎ নৈতিক স্খলন ফৌজদারি অপরাধে যে কোনো মেয়াদের সাজা হলেই সিইসি বা কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে জানান শহীদুজ্জামান সরকার। বৈঠক শেষে মুঠোফোনে এ কথা বলেন তিনি।
এর আগে ২৩ জানুয়ারি বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়। খসড়া আইনে সার্চ কমিটির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেধে দেওয়া যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।
‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ -এর মাধ্যমে সার্চ কমিটির মাধ্যমে এর আগে গঠিত সব নির্বাচন কমিশনের বৈধতাও দেওয়া হবে।
এ অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে বলে খসড়া আইনে বলা হয়েছে।
বিলে বলা আছে, সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।
বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য বিলটি আনা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের শূন্যপদে নিয়োগদানের জন্য এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে ছয়জন সদস্য সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন।
কমিটিতে থাকবেন- প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক, যিনি তার সভাপতিও হবেন। প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক।
বিলে বলা হয়, অনুসন্ধান কমিটি তাদের সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে। অন্যূন তিন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে এবং ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে এর সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে।
অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করবে।
অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে এবং এজন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।
অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির কাছে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতায় বলা হয়েছে- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
অযোগ্যতায় বলা হয়েছে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সুপারিশ করা যাবে না, যদি তিনি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হন। তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন। তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন।
এছাড়া তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, International Crimes (Tribunals) Act, 1973 Act No. XIX of 1973) বা Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (President’s Order No. 8 of 1972) এর অধীন যে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও পদের যোগ্য হবেন না।
বিলটির উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়, সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বিধান রয়েছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন।
সংবিধানের ওই বিধান বাস্তবায়নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ শীর্ষক বিলের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ প্রদানের নিমিত্ত অনুসন্ধান কমিটি গঠন, অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের জন্য যোগ্যতা-অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত বিলে অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক রাষ্ট্রপতির নিকট প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নাম সুপারিশ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের নিকট থেকে নাম আহ্বান করার বিধান রাখা হয়েছে।