তিনটি কারণে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২১’-প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এগুলো হচ্ছে—ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি খাসভূমিসহ সরকারি যেকোনও প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন ভূমিতে প্রকৃত মালিকের মালিকানা ও দখল নিশ্চিত করা। জালিয়াতি করে তৈরি দলিল বা দলিল ছাড়া ভূমি দখল ঠেকানো এবং এ ধরনের অপরাধ করতে পেশিশক্তির ব্যবহার রোধ করা। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ভূমি অপরাধ দমন আইনের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২১’-এর খসড়ার ওপর মতামত চেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়াটি (বিল) ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রণীতব্য নতুন এই আইনে ২২ ধরনের অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘জেলা প্রশাসক সম্মেলন ২০২২’-এ ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কার্য অধিবেশনে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী নতুন এই আইনের খসড়া প্রকাশ ও সবার মতামতের বিষয়টি অবহিত করেন।
এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান সোলেমান খান উপস্থিত ছিলেন।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনের প্রাথমিক খসড়ায় ভূ-সম্পদ সম্পর্কিত ২২ ধরনের অপরাধের শ্রেণি ও মাত্রাভেদে ন্যূনতম ৩ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরাধ পুনঃসংঘটনে আগের শাস্তির দ্বিগুণ দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
কয়েকটি শ্রেণির অপরাধকে অজামিনযোগ্য প্রস্তাব করা হয়েছে। জমির পরিমাণ ও অপরাধের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্ধিত সাজার বিধানও রাখা হয়েছে প্রস্তাবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় মনে করে, বাংলাদেশে সিংহভাগ মামলাই হয় ভূমি বিরোধের জেরে। এ সম্পর্কিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা ঝুলে থাকে দীর্ঘসময়। এতে মামলাজটে যে ভোগান্তি দেখা দেয় তা নিরসনে প্রস্তাবিত আইনটি ভূমিকা রাখবে বলে মন্ত্রণালয় মনে করে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিক খসড়ার ওপর নাগরিক ও অংশীজনের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরে সংশোধিত খসড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এরপর আইন প্রণয়নের পরবর্তী ধাপ শুরু হবে।
প্রস্তাবিত আইনে চিহ্নিত ২২টি অপরাধ
১। জাল দলিল বানানো।
২। মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদন করা।
৩। মালিকানার অতিরিক্ত জমি লিখে নেওয়া।
৪। পূর্ব বিক্রয় বা হস্তান্তর গোপন করে জমি বিক্রি করা।
৫। বায়নাকৃত জমি নিয়ে পুনরায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া।
৬। ভুল বুঝিয়ে দানপত্র তৈরি।
৭। সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজ নামে অধিক জমির দলিল তৈরি।
৮। সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার অধিক জমি বিক্রি করা।
৯। জমির অবৈধ দখল।
১০। সহ-উত্তরাধিকারীর জমি জোরপূর্বক দখলে রাখা।
১১। অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালি উত্তোলন ইত্যাদি।
১২। জলাবদ্ধতা তৈরি করা।
১৩। বিনা অনুমতিতে ভূমির ওপরের স্তরের (টপ সয়েল) মাটি কাটা।
১৪। অধিগ্রহণের আগে জমির মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত মূল্যে দলিল নিবন্ধন করা।
১৫। জনসাধারণের ব্যবহার্য, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করা।
১৬। বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি স্থাপন।
১৭। রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কর্তৃক জমি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ইত্যাদি সম্পর্কিত অপরাধ।
১৮। সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জমি বেআইনি দখল করা।
১৯। নদী, হাওর, বিল ও অন্যান্য জলাভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা।
২০। অবৈধ দখল গ্রহণ ও দখল বজায় রাখতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করা।
২১। সন্নিকটবর্তী ভূমি মালিকের ভূমির ক্ষতিসাধন ও
২২। এ সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনা দেওয়া।
ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, মতামত পাওয়ার পর এসব অপরাধের সঙ্গে আরও অপরাধের ধরন যুক্ত হতে পারে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে জমি দখল, দুর্নীতি ও জমি সংক্রান্ত মামলা কমাতে একটি কার্যকর ব্যবস্থার অংশ হিসেবেই এ আইনের প্রাথমিক খসড়া তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।