কয়েক মাস ধরে বিশ্বরাজনীতির আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব। আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে বলে বিশ্বাস পশ্চিমাদের। এই আশঙ্কা সত্যি হলে বিশাল পরিবর্তন আসতে পারে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক বাজারে। বন্ড, শস্যদানা, তেল-গ্যাসসহ অন্তত চারটি বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্ববাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। মত ও পথ পাঠকদের জন্য এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
১. সেফ হ্যাভেন
কয়েক দশকের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সম্ভাব্য সুদের হার বৃদ্ধির শঙ্কার মধ্যে বন্ড বাজারের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি লড়াই শুরু হলে এ পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুই বছর মেয়াদী ট্রেজারি আয় ২০১৬ সালের পর থেকে এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়েছে, এছাড়া ১০ বছর মেয়াদী হার দুই শতাংশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো ১০ বছর মেয়াদী আয় ০ শতাংশের ওপর উঠেছে।
বড় কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনার সময় সাধারণত বিনিয়োগকারীদের বন্ডের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। কারণ একে পৃথিবীর ‘সবচেয়ে নিরাপদ’ সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়। ফলে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে এবং এরপর মূল্যস্ফীতি দেখা দিলেও বন্ডে তেমন কোনো সমস্যা হবে না ধরে নেওয়া যায়।
অন্য সেফ হ্যাভেনগুলোর মধ্যে স্বর্ণের দাম এরই মধ্যে দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। একই অবস্থা ইয়েনেরও।
২. গম ও শস্যদানা
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এর প্রাপ্র্যতা নিয়েও রয়েছে সংশয়। এ অবস্থায় কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে শস্য রপ্তানিতে যেকোনো ধরনের বাধা পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলতে পারে।
এ অঞ্চলের চার বৃহত্তম শস্যদানা রপ্তানিকারক ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে সরবরাহ ব্যবস্থা ও দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিশ্চিত।
আন্তর্জাতিক শস্য কাউন্সিলের তথ্যমতে, ২০২১-২২ মৌসুমে ভুট্টা রপ্তানিতে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় ও গম রপ্তানিতে চতুর্থ হওয়ার পথে রয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়া এখনই বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক।
ইউবিএসের কৌশলবিদ ডমিনিক স্নাইডার বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটি আগামীতে গমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
৩. তেল ও গ্যাস
রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা সংঘর্ষে রূপ নিলে জ্বালানি বাজারে এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। ইউরোপ প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, যার বেশিরভাগই পাইপলাইনের মাধ্যমে বেলারুশ ও পোল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে পৌঁছায়। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গেছে, বাকিগুলো গেছে ইউক্রেন হয়ে।
লকডাউনের মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ কমে গিয়েছিল, গত বছর চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ আগের অবস্থায় ফেরেনি। এর ফলে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়তে দেখা গেছে।
ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা হিসেবে জার্মানি বলেছে, তারা নতুন নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের কাজ স্থগিত করতে পারে। মস্কোর ওপর জ্বালানিনির্ভরতাও কমিয়ে আনতে পারে ইউরোপ।
দুই প্রতিবেশীর দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তেলবাজারও। জেপি মরগ্যান বলেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা তেলের দাম বাড়ানোর ‘বাস্তব ঝুঁকি’ তৈরি করেছে। এতে বছরের প্রথমার্ধে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে।
৪. আঞ্চলিক ডলার বন্ড ও মুদ্রাবাজার
সামরিক পদক্ষেপের কারণে কোনো বাজারে অধঃপতন হলে তার সম্মুখসারিতে থাকবে রাশিয়া ও ইউক্রেন। উভয় দেশেই ডলার বন্ডের পারফরম্যান্স কয়েক মাস ধরে ভালো যাচ্ছে না। মস্কো ও তার মিত্রদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উত্তেজনা বাড়ায় মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
ক্ষতির মুখে পড়েছে রাশিয়ার রুবল এবং ইউক্রেনের রিভনিয়াও। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত উদীয়মান বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করা মুদ্রা এ দুটি।
আইএনজি’র গ্লোবাল হেড অব মার্কেটস ক্রিস টার্নারের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের ভূ-রাজনীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ‘উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা’ তৈরি হয়েছে।