বিগত দুই বছর অতিমারি কভিড শুধু আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এলোমেলো করে দেয়নি, জীবন সংহার করেনি, পাশাপাশি অনেক কিছু শিখিয়েছেও। আমরা ক্লাস, পরীক্ষা, মিটিং, সেমিনার অনায়াসে ভার্চুয়াল মাধ্যমে করতে শিখেছি। জুম, গুগল ক্লাসরুম, ক্যানভাস ইত্যাদি সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আবার ক্ষমতাবান বিশেষজ্ঞ ও সরকারি বিধায়করা মানুষের জীবন রক্ষার প্রয়োজনে হোক বা নিজেদের গা বাঁচানোর চিন্তায় হোক লাখো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ চিন্তাকে প্রাধান্য না দিয়ে, জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা না করে কী করে এক লহমায় মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে জীবন বিপন্ন করে দিতে পারে তা-ও শিখিয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অচল অবস্থা নিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধু আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, যে সময়কাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব প্রকৃত শিক্ষাবিদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতদের হাতে অর্পণ করা হতো সে সময় পর্যন্ত দৃশ্যপট এক রকম ছিল। উপাচার্য থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক—সবাই ক্যাম্পাসে শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ বজায় রাখা ও ছাত্র কল্যাণের দিকে নজর রাখতেন। তাই সে সময় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটিও ছিল শ্রদ্ধা-স্নেহে জড়ানো। সে যুগে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা ছাড়া ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও আমরণ অনশনে যাওয়ার মতো চিন্তাও করা হতো না। কিন্তু সে সত্য যুগ পাল্টে গেছে। এখন কূট রাজনৈতিকীকরণের ঘেরাটোপে আমরা আটকে গেছি। এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার তপোবন থাকল কি না তাতে কিছু যায় আসে না। যায় আসে যদি নিজ দলের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়কে রাখা না যায়। তাই জ্ঞান-পাণ্ডিত্যের যোগ্যতা বাতিল হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হতে লাগল দলীয় আনুগত্যের যোগ্যতায় যাঁরা উত্তীর্ণ হতে পারছেন তাঁদের। ফলে এই ধারার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালকদের কাছে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা বড় না হয়ে সরকারি স্বার্থ রক্ষা বড় হয়ে যায়। এমন দর্শন বজায় থাকায় ক্যাম্পাসের একাডেমিক স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়া স্বাভাবিক। আর এসবের মধ্য থেকে সৃষ্টি হয় নানা অস্বস্তি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটতে থাকে। এমন বাস্তবতাই তো আমরা কিছুদিন পর পর বিভিন্ন ক্যাম্পাস অচল হতে দেখি।
সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত ভিসি পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চলে এসেছে। এই দাবি আদায়ে শেষ পর্যন্ত অনশনে নামতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে তারা অনশন চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তা হলে একজন বিবেকবান শিক্ষক উদ্ভূত ঘটনায় নিজেকে দায়ী মনে না করলেও শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ কল্যাণ চিন্তায় পদত্যাগ করলেই তো পারেন। ’ আমি বললাম, যেভাবে এখন নানা পথঘাট মাড়িয়ে, নানা তদবিরের পথ হেঁটে অমন একটি পদ পাওয়া যায়, সেই পদ ছেড়ে দেওয়া কি এত সহজ!
একইভাবে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কভিডসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্তের সুযোগে বৃহত্তর ছাত্র কল্যাণ বিবেচনায় মাথা খাটিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো বিকল্প বের না করে হুট করে মাঝ দরিয়ায় নৌকা ডুবিয়ে দেয়। বিদেশি টিভি চ্যানেলে মাঝে মাঝে স্নেক ক্যাচারদের এপিসোড দেখি। কারো বাড়িতে বিষাক্ত সাপ ঢুকেছে। সাপটিকে মেরে ফেলে আপদ বিদায় করা সহজ। তার বদলে সচেতন মানুষ স্নেক ক্যাচারদের খবর দেন। তাঁরা এসে অনেক কষ্টে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাপকে অক্ষত ধরে ব্যাগ-বন্দি করেন। পরে লোকালয়ের বাইরে দূরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসেন।
কিন্তু আমরা সহজেই সাপকে মেরে নিজেদের নিরাপদ রাখতে চাই। আমাদের কর্তারা নিজেদের নিরাপদ রাখার বিষয়টি আগে ভাবেন। স্কুল-কলেজ খোলা রাখায় কভিড সংক্রমণ বাড়লে সরকার সমালোচিত হবে, তাই বড় একাডেমিক ক্ষতি এড়ানোর নানা বিকল্প নিয়ে চর্চা না করে মাথাটাই কেটে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চান। বছর দেড়েক আগে তো তেমনই হয়েছে। আমরা অনেকেই লেখালেখির মাধ্যমে বলতে চেয়েছিলাম এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা ছেলেখেলার স্টাইলে না নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানিয়ে সরাসরি নেওয়া সম্ভব ছিল। আমরা বলেছিলাম, প্রত্যেক নির্ধারিত পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছাকাছি একাধিক প্রাইমারি, হাই স্কুল জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা স্বাভাবিক। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আসন ছড়িয়ে দিলে নিরাপদ দূরত্বে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া যেত। কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবেও সে চেষ্টা করতে দেখিনি আমরা। পরীক্ষার হলে না এসে নিজ বাড়ি, বাজার-হাট আর রাস্তাঘাট বেশি নিরাপদ তেমন সার্টিফিকেট কি বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন? আমার জানা মতে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে এক পর্যায়ে ঢাকার বাইরের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে উঠে গিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা সরাসরি ক্লাস পরীক্ষা নিয়েছেন। সব কিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয়েছে। কই, সেখানে কভিড ছড়িয়ে পড়েছে তেমন তথ্য তো আমরা জানি না। গত বছর আমরা মাস্টার্সের বেশির ভাগ পরীক্ষা নিয়েছিলাম। কারো একটি, কারো দুটি পরীক্ষা বাকি ছিল। কোনো ব্যাচের সব পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল, শুধু মৌখিক পরীক্ষা বাকি। যদি সময়মতো পরীক্ষা দিয়ে ফেলতে পারত, তাহলে পেশাজীবনে প্রবেশ করার লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকারি নির্দেশে হঠাৎ সব বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। সরকারি অনুকম্পায় আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা সরকারি সিদ্ধান্তের পর নিজেদের বক্তব্য উত্থাপন করেননি। এভাবে বিনা কারণে কমপক্ষে ছয় মাসের সেশনজটে পড়ে যেতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের।
কিছুদিন আগে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় আমরা অনেকবার লিখেছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হল থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিলে সব কিছুর সমাধান হয় না। তারা তো মিশে যাবে পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে। সেখানে কি কভিড ছড়াবে না? তার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব। এসব যুক্তিতে তখন কেউ কর্ণপাত করেননি। এবার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর হল খোলা রাখার পক্ষে এসব যুক্তিকেই সামনে এনেছেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি অটল থাকতে পারেননি। সংক্রমণ চোখ রাঙাতেই যুক্তি খেই হারাল।
এত অভিজ্ঞতার পরও আবার একই পথে হাঁটল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ২৩ জানুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদে আবারও শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্য দেখতে পেলাম। এবারও কোনো বিকল্প চিন্তা না করে চূড়ান্ত পরীক্ষা মাঝ পথে বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিপন্ন করে তুলল। রিপোর্টে দেখা গেল সরকারি নির্দেশে হঠাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চলমান পরীক্ষাও স্থগিত করা হলো।
তথ্য মতে, রাজধানীর সাত কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলছিল। বাস্তবতা বিবেচনা না করেই শেষ পরীক্ষার দিন স্থগিত করে দেওয়া হলো পরীক্ষা। কোনো বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে শুধু মৌখিক পরীক্ষা বাকি ছিল। অর্থাৎ সব বর্ষের পরীক্ষাই জানুয়ারির মধ্যে শেষ হয়ে যেত। এই ঘোষণার জেরে এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
আমরা মনে করি, সরকারপক্ষ নিজেদের গা বাঁচানোকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল তা নিয়ে ভাবতে পারত। সেটাই উচিত ছিল। এর মধ্যে শিক্ষকদের প্রায় শতভাগই দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। কেউ কেউ বুস্টার ডোজও নিয়েছেন। কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই টিকার আওতায় চলে এসেছে। বাস্তবতার নিরিখে এদের পরীক্ষা নেওয়ার অন্তত একটি বিকল্প পন্থা নিয়ে ভাবাই যেত।
বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সরকারি বিধায়কদের কাছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ভাবাটা জরুরি কিছু নয়। জরুরি হচ্ছে নিজেদের কিভাবে নিরাপদ রাখা যায়। করোনা-ওমিক্রন সংক্রমণে স্বাস্থ্যঝুঁকি ইত্যাদির বাস্তবতা সম্পর্কে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষ যে ওয়াকিফহাল নন, তেমন তো নয়। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার বিকল্পগুলো তাঁদের জানা থাকার কথা বেশি। তেমন শিক্ষাবিদদের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা সরকারপক্ষ মনে করে করেছে কি না জানি না; নাকি তাঁদের পরামর্শ নেওয়া হয়, যাঁরা রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় সরকারি ইচ্ছাকে বরাবর তথাস্তু বলেন! আমরা বিধায়কদের কাছে অনুরোধ করব, দয়া করে ভেবে দেখবেন অন্তত চলমান পরীক্ষা শেষ করার বিকল্প পন্থা ঘোষণা করতে পারেন কি না।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com