মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশের কাস্টমার কেয়ারের হেল্পলাইন নম্বর ক্লোন বা স্পুফিং করে এজেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। শ্যালক ও দুলাভাইয়ের এই চক্রটি প্রায় ৭ বছর ধরে এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। র্যাবের দাবি, প্রতারণার মাধ্যমে চক্রটি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণা চক্রের মূল হোতাসহ গ্রেপ্তার ৩ জন এর আগেও একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
একটি বিদেশি পেইড অ্যাপস ব্যবহার করে তারা নম্বর ক্লোনের মাধ্যমে এই প্রতারণা করছিলেন। তারা তিন ধাপে এই প্রতারণা করতেন। প্রথম ধাপে টাকার বিনিময়ে নিম্নআয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষের নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করে তা সংগ্রহ করতেন। দ্বিতীয় ধাপে বিদেশি অ্যাপস ব্যবহার করে এজেন্টদের তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিতেন। সবশেষ প্রতারণার মাধ্যমে আনা টাকা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসে ক্যাশআউট করা হতো।
এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলে চক্রের প্রথমজন পেতেন ১২ হাজার, দ্বিতীয়জন ৩৫ হাজার এবং শেষ ধাপে চক্রের সদস্যরা পেতেন ৬৫ হাজার টাকা।
র্যাব বলছে, এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে মোটা অংকের বিনিময়ে বিকাশ এজেন্ট ও সেলস রিপ্রেজেন্টদের তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রতারণা করা হতো।
মঙ্গলবার থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মুন্সীগঞ্জ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে শ্যালক-দুলাভাইয়ের বিকাশ প্রতারণা চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- চক্রের হোতা নুরুজ্জামান মাতুব্বর, সজিব মাতুব্বর ও সুমন শিকদার (৪৫)। নুরুজ্জামান ও সজিব সম্পর্কে শ্যালক দুলাভাই। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১৩টি মোবাইল, ২৪টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চক্রের সদস্যরা স্বল্প শিক্ষিত হলেও প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের বিশেষ জ্ঞান ছিল। তাদের পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন মোস্তাক। তিনি ফরিদপুরে বসে চক্রের সদস্যদের পেইড অ্যাপসের টাকা পরিশোধ ও আইডি পাসওয়ার্ড দিতেন।
বুধবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টদের টার্গেট করে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অসাধু মোবাইল সিম বিক্রেতার সঙ্গে পরস্পর যোগসাজসে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, খেটে খাওয়া মানুষ ও সহজ সরল মানুষদের এনআইডি ব্যবহার করে সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করতেন। এরপর বিকাশ হেল্পলাইনের নম্বর ক্লোন করে নিজেদের মোবাইল ব্যাংকিং হেড অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। এরপর কৌশলে এজেন্টদের পিন কোড জেনে নিয়ে মোটা অংকের টাকা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিত। এরপর তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা চক্রের সদস্যদের নম্বরে পাঠিয়ে দিতেন। তাদের যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শনাক্ত করতে না পারে এর কৌশল হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে টাকা পাঠিয়ে অধীনে থাকা এজেন্ট থেকে টাকা সংগ্রহ করা হতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই গ্রুপের ২০-২৫ জন সদস্য রয়েছে।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও জানান, প্রতারক চক্রের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ৫০ থেকে ৬০টি বেশি সিমকার্ড থাকে। একবার প্রতারণার কাজ শেষ হলেই ব্যবহৃত সিমকার্ডটি ফেলে দেওয়া হতো। চক্রের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মোবাইল নেট ব্যবহার না করে ওয়াইফাই অথবা পকেট রাউটার ব্যবহার করতেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, চক্রের অন্যতম হোতা নুরুজ্জামান মাতুব্বর মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০০০ থেকে ঢাকায় স্যানিটারি মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৫ সাল থেকে এই চক্র গড়ে তোলেন। তার বিরুদ্ধে তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলা রয়েছে। তিন মাস আগে জামিনে বের হয়ে আবারও এই প্রতারণার কাজে যোগ দেন।
শ্যালক সজিব মাতুব্বরও তৃতীয় শ্রেণি পাস। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। আর গ্রেপ্তার সুমন শিকদার মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ১৯৯৬ সালে শ্রমিক ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান। ২০০১ সাল থেকে বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ কোম্পানির এসআর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে প্রতারক চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। কমিশনের বিনিময়ে প্রতারক চক্রের কাছে বিকাশ এজেন্টদের তথ্য সরবরাহ করতেন।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারের খবর ফাঁস হওয়ায় চক্রের অন্য সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছে। এই চক্রের দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক সহযোগী রয়েছে। শ্যালক-দুলাভাইয়ের এই চক্র এখন পর্যন্ত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।