আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা দেশে অনেক আছে। কখনো শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের আন্দোলনের চাপে। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আভ্যন্তরিণ রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে। কখনো বা উপাচার্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে। উপাচার্যদের সম্মানজনক উপায়ে পদত্যাগ করার ঘটনাও আছে। তাঁদের কথা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে একজন উপাচার্যকে অপসারণ করে সরকার। ওই সরকার এর জন্য আজও সমালোচিত।
কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের বিরুদ্ধে যৌক্তিক আন্দোলন হলে শেষ পর্যন্ত সাধারণত শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক অতীতে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যাঁরা করছেন, সেই ব্যাপারে প্রমাণ দিতে না দিতে পারলে তাঁদেরকে শাস্তি পেতে হবে। পরে আন্দোলন থেমে যায়, উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়নি।
সাধারণত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠলেও ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বড় হলে বড়জোর কোনো কোনো উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া বা পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় যুগের পর যুগ ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে আসছে বলে অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে উপাচার্য হওয়া শিক্ষকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বও দেন না।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৩ বছরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ উপাচার্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। অনশন ভাঙলেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পদত্যাগ করলে তালিকায় সবশেষে যোগ হবে ফরিদ উদ্দিনের নাম। এর আগে ২০০৯ সালে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ। জাবির উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেন ২০১২ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালে, একই বছর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হককেও পদত্যাগ করতে হয়।
১৯৯৩ সালে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হামলার প্রতিবাদ থেকে গড়ে উঠা আন্দোলনে জাবির উপাচার্য কাজী সালেহ আহমেদ পদত্যাগে বাধ্য হন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আলাউদ্দিন আহমেদকে ১৯৯৯ সালে পদত্যাগ করতে হয়। আব্দুল বায়েসকে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে জাবির উপাচার্যের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। জসিম উদ্দিন ২০০৪ সালে শিক্ষক আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ছাড়েন।
২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দিনের বেলা দায়িত্ব নিয়ে মধ্যরাতেই ঢাবির উপাচার্য পদে যোগ দেন আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। তখনকার উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী অনেকটা বাধ্য হয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে দায়িত্ব নেওয়ার নয় মাসের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আনোয়ার উল্লাহ। এরশাদের সময়ে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা বিএনপি সরকারের প্রায় আড়াই বছরের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯২ সালে ছাত্রশিবিরের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনকে বিতর্কিত কায়দায় অপসারণ করে বিএনপি-জামায়াতের সরকার।
সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে বিভিন্ন সময়ে ঢাবির অন্তত পাঁচজন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। উপাচার্য মাহমুদ হুসেইন ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলমান রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেইনের ভাই। ১৯৬২ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ঢাকা কলেজে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর মোনায়েম খান ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কোনো ব্যবস্থা না নিলে মোনায়েম খান ‘সন্তুষ্ট’ না হওয়ায় মাহমুদ হুসেইন পদত্যাগ করেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। ঢাবির ওই সময়ের উপাচার্য, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় ঢাবির দুজন ছাত্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৬ সালে উপাচার্য মোহাম্মদ শামসুল হক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের অন্যায় আদেশ না মেনে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের চাপে ‘স্বাস্থ্যগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী।