প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ও অন্যতম নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আবারো তর্কে জড়ালেন। একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে ‘মারাত্মক ও গুরুতর’ অভিযোগ করছেন। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের ‘নৈতিক অধ:পতন ও বাড়তি রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ’ বেশ পুরনো। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দায়িত্ব পালনের শুরু থেকে মেয়াদের শেষ সময়ের আগে পর্যন্ত তাঁরা কয়েকবার ‘বাকযুদ্ধে’ জড়ান। বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। শেষ সময়ে এসেও তাঁদের ‘পুরনো পদ্ধতিতে তর্কে জড়ানোর’ নেপথ্যে আসলে কী আছে?
মত ও পথের পর্যালোচনা, অনুসন্ধান বলছে, সংসদ ভবন থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকান আর সচিবালয় থেকে শুরু করে সুশীল নাগরিকদের ঘরে পর্যন্ত সিইসি ও তালুকদারের ‘তর্ক-বিতর্ক’ বিভিন্ন সময় ‘আলোচনার খোরাকে’ পরিণত হয়। রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারাও দুজনের ‘তর্কযুদ্ধের’ পক্ষে ও বিপক্ষে নিজ দলের অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন সময় বক্তব্য দেন। একটি সাংবিধানিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত থেকে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের প্রকাশ্যে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণের’ ঘটনা ইসির ইতিহাসে তেমন নেই। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মতবিরোধের বিষয়গুলো অবশ্য ইতিবাচকভাবে দেখেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, এটা গণতান্ত্রিক সমাজের অনুষঙ্গ। তবে হুদা ও তালুকদারের ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের’ পেছনে আছে ইসিতে নূরুল হুদাকে ‘বস’ হিসেবে মাহবুব তালুকদারের মেনে নিতে না পারা।
জানা গেছে, দুজনই দেশের প্রশাসনে দীর্ঘদিন চাকরি করেন। বয়স ও চাকরির সুবাদে মাহবুব তালুকদার জ্যেষ্ঠ! তাঁর অধীনে একসময় নূরুল হুদা কাজ করতেন। মাহবুব তালুকদার একসময় সংসদ সচিবালয়ে অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। ওই সময় নুরুল হুদা ছিলেন সেখানে যুগ্মসচিব। তখন তালুকদার ছিলেন ‘বস’। হুদা কমিশনে যোগ্যতা, দক্ষতা ও আস্থায় ‘বসের পদে’ আছেন নূরুল হুদা। সংসদ সচিবালয়েও দুজন কয়েকবার ‘তর্কে ও দ্বন্দ্বে’ জড়ান। তখন সংসদ সচিবালয়ের সচিব ছিলেন প্রয়াত মনজুরে মওলা। তিনি একাধিকবার তাঁদের ‘দ্বন্দ্ব’ সামাল দেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারার ক্ষমতা পেশাদার আমলাদের যেমন থাকে, সেটা মাহবুব তালুকদার ইসিতে দেখাতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে। গণমাধ্যমে ‘তর্কে’ জড়িয়ে প্রায়ই তিনি আলোচনা-সমালোচনায় থাকতে চেয়েছেন। ইসিতে দায়িত্ব পালনের শুরু থেকে তাই তাঁদের সম্পর্কে ‘টানাপোড়েন’ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।
নূরুল হুদার সঙ্গে এমন ‘সম্পর্কের’ কথা লেখক মাহবুব তালুকদার নিজের স্মৃতিকথায়ও উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, ‘জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে পূর্বে দুটি অতিরিক্ত সচিবের পদ ছিল। প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদনেত্রীর অফিসের একটি অতিরিক্ত সচিবের পদ জাতীয় সংসদে সাময়িকভাবে অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে আমাকে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব আমি কিছুই জানতাম না। তবে এ ব্যাপারে সবই আইনসিদ্ধভাবে করা হয়েছিল। প্রথম হোঁচট খেলাম, আমার অধীনস্থ যুগ্মসচিব নূরুল হুদা সচিবের কাছে একটি নোট পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, আমি বহিরাগত বলে আমার নির্দেশ তিনি মানতে বাধ্য নন। সচিব তাঁকে ভর্ৎসনা করে বললেন যে, এটা তাঁর ইনসাবর্ডিনেশনের পরিচায়ক। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেন না’ (সূত্র: মাহবুব তালুকদার, আমলার আমলনামা, মাওলা ব্রাদার্স)।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ঢাকার আগারগাঁওয়ের ইসি ভবনে মাহবুব তালুকদারকে ‘রোগাক্রান্ত ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেন কে এম নূরুল হুদা। সিইসি বলেন, ‘তিনি (মাহবুব তালুকদার) কখনো আইসিইউতে, কখনো সিসিইউতে থাকেন। সিঙ্গাপুরে ট্রিটমেন্ট (চিকিৎসা) করেছেন, ভারতে ট্রিটমেন্ট করেছেন। বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার ট্রিটমেন্ট করেন, এটা ইসি বহন করে থাকে।’ তাঁর এ বক্তব্যের জের ধরে শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেন মাহবুব।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন অবস্থানের কারণে সিইসি কে এম নূরুল হুদা প্রতিহিংসা’র মতো নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছেন।’ বর্তমানে কর্মরত নির্বাচন কমিশনাররা ও অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনাররা প্রাপ্যতা ও বিধি অনুযায়ী ইসি থেকে চিকিৎসার খরচ নিয়ে থাকেন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন মাহবুব তালুকদার। ২০২১ সালের ‘ভোটার দিবসেও’ তাঁরা ‘তর্কে’ জড়ান। দিবসটি পালন করতে ইসি নিজ কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে, যা রূপ নেয় ‘তালুকদার ও হুদার বাগ্যুদ্ধে’।