করোনাকালে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও সমাধান

ডা. সুলতানা আলগিন

ডা. সুলতানা আলগিন
ডা. সুলতানা আলগিন। সংগৃহীত ছবি

সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সমস্যার মিথস্ক্রিয়ায় মানসিক চাপ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে আজ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। করোনাকালে সবাই কোনো না কোনোভাবে মানসিক চাপে ছিলেন এবং আছেন। আমাদের দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বর্তমানে জনসংখ্যার ১৭.১ শতাংশ। তাঁদের বেশির ভাগ এখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। বড় অবহেলিত তারুণ্য। নারী ও বয়স্কজন দরকারি সেবা পাচ্ছেন না।

করোনা নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। বিশাল তরুণসমাজসহ সবাইকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সেসব থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকে নিজেকে বদলে নিয়েছেন। তারুণ্য হলো দেশ, সমাজে বিশ্বের অফুরন্ত সম্ভাবনার সম্পদ। সেই তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন আছে করোনায়। কিভাবে সমস্যা, মন, বিপন্নতা, বিষণ্নতা, কষ্ট, বন্দিত্ব মোকাবেলা করছে তারুণ্য। বদলে যাওয়া সময়ে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারছে তারা।

সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে, কম নয়। উদ্বেগ ছিল করোনায় কতটা বদলে যাবে পৃথিবী। সেসব কেমন করে সামলাবে তরুণ মন। অস্থিরতা ছিল। নেতিবাচক মনোভাব, হতাশা, লাইফস্টাইলের নানা খুঁটিনাটি, খাদ্যাভ্যাস অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে তারুণ্যের সামনে। মাদকাসক্তি কমেনি। হতাশা বেড়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নিয়ে কতটাই বা ব্যস্ত সময় কাটে। বরং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আসক্তি কাবু করেছে অনেককে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। সেটা তরুণ মনের পক্ষে মেনে নেওয়া বড় কষ্টকর। সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অংশগ্রহণ তরুণ মনের নিত্য চাহিদা। সেটা বিঘ্নিত হয়েছে। খেলাধুলা হয়নি। এসব সমস্যা তরুণ মনকে করেছে ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্বের পাশাপাশি এসব বাংলাদেশেরও চিত্র। গোটা ভারত উপমহাদেশের তারুণ্যের সমস্যার চিত্র।

করোনকালে নতুন এবং পুরনো মানসিক রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। করোনাকালে অনেকেই মানসিক চাপ নিতে না পেরে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যারা আগে থেকেই অসুস্থ ছিল তাদের রোগের প্রকোপ লক্ষণ বেড়ে গিয়েছে।

কেন মানসিক সমস্যা বেড়েছে

তরুণসমাজ যেকোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি। তারা গত দুই বছরে সব দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। কেউ মা-বাবা হারিয়েছে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পড়াশোনায় পিছিয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ ভাবনা তাদের মাথায় চেপে বসেছে। পরীক্ষার তারিখ পড়ছে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চাকরির পরীক্ষায় বসার বয়স অনেকের চলে যাচ্ছে। দেশের বাইরে যারা পড়াশোনা করছিলেন তাঁরা অনেকেই ফিরে এসেছেন। আবার যাঁরা বাইরে যেতে চান তাঁরা করোনায় ফিরে যেতে পারছিলেন না। আর অনেকেই রাত জেগে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সময় মিলিয়ে ক্লাস করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। পাশাপাশি অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়েও শেষে অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে অনেকে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। কারো মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়ে গেছে।

যে মানসিক রোগগুলো বেড়েছে

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অনিদ্রা সমস্যা বেড়ে গেছে। অল্প বয়সীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার যদিও কম দেখা গেছে কিন্তু সংক্রমিত হওয়ার ভীতি, সামাজিক দূরত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষতি, অনিশ্চয়তা তাদের মনে চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে। এই বয়সে স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি ছেড়ে ঘরে বসে থাকার বিষয়টি মেনে নিতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যে সময়টায় ক্লাস শেষে টিএসসি, খেলার মাঠে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হতো সেই অফুরন্ত সময় এখন কে কিভাবে কাটাবে বুঝে নিতে সময় লেগেছিল। সারা রাত জেগে দিনে ঘুমানো; অনলাইন ক্লাসে স্ক্রিনে ক্যামেরা বন্ধ রেখে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকত। নিজেদের অজান্তে নিজেকে অনেক ফাঁকি দিয়েছে। ফলে পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে অনেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার পর আবার বন্ধের ঘোষণায় সবার মধ্যে হতাশা-উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। মোবাইল গেম, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম, বদমেজাজ, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, একাকিত্ব, মাদকাসক্তির মতো অস্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল অনেকেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯-এর মার্চ-অক্টোবরের তুলনায় ২০২১ সালের এই সময়ে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। সেসিল রস স্কুলছাত্রদের ওপর এক সমীক্ষায় বলেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরত্বই অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের বদমেজাজি, মানসিক চাপ ও দূরত্ব তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ।

করোনায় সামাজিক দূরত্ব মানতে গিয়ে একাকিত্ব বিষণ্নতা হতাশা পেয়ে বসে অনেককে। সংক্রমণ ঠেকাতে হাত স্যানিটাইজ থেকে শুরু করে কাপড়চোপড়, গোসল এমনকি শাক-সবজি পত্রিকাও স্যানিটাইজ করতে দেখা গেছে। অনেকের মধ্যে শুচিবায়ু বা ওসিডি রোগের শুরু হয়েছে এই প্যানডেমিকে। টিভিতে, মোবাইলে সারা দিন মৃত্যু সংবাদ, লাশের দাফনের ছবি, অ্যাম্বুল্যান্সের হর্ন, রোগের প্রকোপ বাড়া-কমার সংবাদ মানুষের মধ্যে অনেক স্ট্রেস সৃষ্টি করেছে। ঘুম এবং খাওয়ার সব রুটিন ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় মানুষ অনিদ্রা, ইটিং ডিসঅর্ডার, স্থূলতা রোগে ভুগছে বেশি। দেশের কোস্টাল এরিয়াগুলোতে ডিপ্রেশন, সুইসাইড বেশি দেখা গেছে। এক সমীক্ষায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ৬.৯ শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পাওয়া যায়।

আচরণের বহিঃপ্রকাশ

প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নেয় বা বিদ্রোহ করে। যারা নিজেকে গুটিয়ে নেয় তাদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্নতা কাজ করে। তারা কাউকে বিরক্ত করতে চায় না। নিজেদের আড়াল করে রাখে। পরিবারে পারস্পরিক দুর্ব্যবহারের মাত্রাও এখানে প্রভাব ফেলে। তাদের হঠাৎ পরিবর্তিত আচরণ আশপাশের স্বজন-পরিজনদের জন্য সতর্কবাণী; কিন্তু তাদের অবহেলা এই মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির তরুণসমাজকে আরো দুর্বল করে দেয়। আর যারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তাদের মধ্যে মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকাশে সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। রিলেশনশিপ, পারস্পরিক আস্থায় দূরত্ব আনে। পারিবারিক সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই তারা বিক্ষিপ্ত থাকে।

যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগ তরুণদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানসিকসেবা দেওয়ার কাজ করেছে। এখন আরো অগ্রাধিকার দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছে। সেবার হাত সব সময় বাড়ানো। চিকিৎসা বিএসএমএমইউসহ সব মেডিক্যালে সুলভ। মানসিক রোগ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক মনোবিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং সেবা নিয়ে সব সময় তরুণদের পাশে থাকে। বিএসএমএমইউসহ সব মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ আউটডোরের সেবা সব সময় তাদের জন্য খোলা। দরকার মতো সেটা তাদের নিতে হবে। দ্বিধা বা দেরি করা চলবে না।

সরকারি সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি, বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য কাজ করে গেছে। ওয়েবিনারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, সাহস জুগিয়েছে। পত্রিকা, লিফলেট, অনলাইনে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ভিডিও কল অনলাইন টেলিমেডিসিন চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে সবার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা জারি আছে এখনো।

যা করণীয়

অ্যারিস্টটল বলেছেন, ভালো অভ্যাস, যা তারুণ্যে সৃষ্টি হয় তা-ই কেবল পার্থক্য আনতে পারে। আশার কথা এই বিপর্যয়ে অনেকেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। করোনায় ক্ষয়ক্ষতি মানসিক বিপর্যয়কে যেভাবে এক জেনারেশন হারিয়ে যাওয়ার ওপর ফোকাস করা হচ্ছিল তা মিথ্যা প্রমাণিত হতে শুরু করেছে। তাই দেরি না করে সন্তানের ও পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। দ্রুত সুরক্ষা ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিক জীবনাচরণে ফিরে যান। তাতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। কিশোর-তরুণদের প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসুন। অস্বস্তি, কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলুন। মানসিক সমস্যা যেকোনো বয়সে যে কারো হতে পারে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সুচিকিৎসায় স্বাভাবিক সুন্দর জীবন যাপন করুন।

লেখক : অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

শেয়ার করুন