জায়েদের এতো ‘প্রশাসনিক দাপটের’ উৎস কি?

হাসান শান্তনু

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিতর্কিত উপায়ে আবারো সাধারণ সম্পাদকের পদে বসেছেন জায়েদ খান। তার প্রবল ‘প্রশাসনিক ক্ষমতা’! এর জোরে পপিকে গুলি করতে পিস্তল ঠেকান। এ অভিনেত্রীর ভাই ও অবিবাহিত বোনকে ‘আপত্তিকর’ মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। সংখ্যালঘুদের বাড়ি দখল করেন। এর প্রতিবাদ করলে তরুণ এক সাংবাদিক নেতাকে পুলিশি হেনস্থা, মামলার ভয় দেখান। এফডিসিতে অনিয়ম, সরকারি পাওনা পরিশোধ না করা, জ্যেষ্ঠ অভিনেতাদের সঙ্গে অসামাজিক আচরণ, প্রতারণা- কোনো কিছুর জন্যই তাকে সামান্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না। তার সঙ্গে মতের অমিল হলে যে কোনো শিল্পীর ভাগ্যে জোটে পুলিশি হেনস্থা। এফডিসিতে প্রচলিত আছে- ‘জায়েদ খান মানে সব মাফ, জায়েদ মানে নিজেই প্রশাসন।’

নট জায়েদের অলিখিত একটা নির্দেশ প্রচলিত আছে এফডিসিতে। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করা যাবে, তবে তার নয়।’ চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ১৮ সংগঠনের উদ্যোগে ২০২০ সালের ১৫ জুলাই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পরিচালক সমিতির নেতা, সিনেমার নির্মাতা মুশফিকুর রহমান গুলজার এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারপ্রধানের গঠনমূলক সমালোচনা করা যায়, জায়েদের সমালোচনা করা যাবে না কেন?’ তাতে জায়েদের দাপট থামেনি। ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যে কয়েক কর্মকর্তা ও এফডিসির ‘গডফাদারখ্যাত’ যে অভিনেতা’ তার ‘ক্ষমতার উৎস’, মত ও পথের অনুসন্ধানে সেসব বেরিয়ে এসেছে।

সিনেমার ক্যামেরার সামনে আনাড়িপনার জন্য সমালোচিত জহিরুল হক মনু ওরফে জায়েদ খান। পিরোজপুরের এক সংখ্যালঘু পরিবারের জমি, চিকিৎসালয়ের (ক্লিনিক) দখলদার হিসেবে সংবাদমাধ্যমের আলোচনা-সমালোচনায় আসেন ২০১৮ সালে। অভিযোগ করেন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক উপাধ্যাক্ষ গীতা রানী মজুমদার। তাঁর স্বামীর প্রতিষ্ঠিত ‘সার্জিকেয়ার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ দখলের। এর অবস্থান পিরোজপুর জেলা সদরের মাছিমপুর বাইপাস সড়কে। ক্লিনিকসহ বাড়ি দখলের অভিযোগ উঠে। ‘নায়ক’ জায়েদসহ তার ভাই পুলিশ কর্মকর্তা শহিদুল হক মিন্টু ও আরেক ভাই ঠিকাদার ওবায়দুল হক পিন্টুর বিরুদ্ধে ক্লিনিকসহ বাড়ি দখলের অভিযোগ করেন গীতা রানী। লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও তখন এ অভিযোগ করেন তিনি।

জায়েদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বাড়ি দখলের অভিযোগের বিষয়ে জাতীয়, স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি প্রতিবেদন নিজের ফেসবুক দেয়ালে শেয়ার করেন ঢাকায় কর্মরত জাতীয় একটি দৈনিকের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও তরুণ সাংবাদিক নেতা। এর কথিত ব্যাখ্যা দিতে তাকে ডাকা হয় ডিএমপি’তে। অভিযোগ আছে, জায়েদের এক ভাই কয়েক বছর আগে ডিএমপি’র একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় পুলিশের তিন থেকে চার কর্মকর্তার সঙ্গে জায়েদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারাই চার বছর আগে ওই সাংবাদিককে ডিএমপির ঢাকার কার্যালয়ে তলব করেন। এ ঘটনা কেন্দ্র করে সাংবাদিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদী হয়। সাংবাদিক নেতা, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা এর প্রতিবাদ করেন।

সদ্য অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে ডিএমপি’র শীর্ষ পর্যায়ের ওই তিন-চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রভাবিত করে জায়েদকে ‘পাস’ করানোর অভিযোগ আছে। মিশা-জায়েদের প্যানেলের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা ভূমিকা রাখেন। যেমন- ভোটের দিন জায়েদের সমর্থকদেরকে অবাধে এফডিসিতে ঢুকতে দেওয়া। ইলিয়াস-নিপুণের প্যানেলের স্বেচ্ছাসেবকদের ঢুকতে না দেওয়া। ভোট উপলক্ষে বাঁশ দিয়ে ঘেরা নির্দিষ্ট স্থানে ভোটদাতাদেরকে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে জায়েদের সমর্থকদেরকে ছাড় দেওয়া। অভিনেত্রী ও জায়েদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিপুণের খাবার সরবরাহে বাধা দেওয়া। এফডিসিকেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে ঢুকতে বাধা দেওয়া। এমনকি ভোটের দিন জায়েদের পরিচিত একশ্রেণির কথিত সাংবাদিকদেরকে ‘গেটপাস’ দেওয়ার সুপারিশ করার ক্ষেত্রেও ডিএমপির ওই কর্মকর্তাদের ভূমিকা আছে।

জায়েদের দাপটের আরেক উৎস বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলের হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠজন, এফডিসিতে ‘গডফাদার’ অভিনেতা হিসেবে খ্যাত ডিপজল। গত বছর অভিনেত্রী পরীমনি আইনি ঝামেলার শিকার হলে শিল্পী সমিতিতে তার সদস্যপদ স্থগিত করে দেন সাধারণ সম্পাদক জায়েদ। পুলিশের কয়েক কর্মকর্তাকে খুশি করতে জায়েদ এটা করেন বলে অভিযোগ আছে। অথচ তখন শিল্পী সমিতির কমিটিতে থাকা ডিপজল, রুবেলের নামেও অভিযোগ, মামলা ছিল। অবৈধ অস্ত্রসহ ডিপজল গ্রেপ্তার হন। একাধিক মামলা আছে তার নামে। একই জমি একাধিকবার বিক্রির অভিযোগে অভিনেতা রুবেলের নামে প্রতারণা মামলা হয় ২০১৮ সালে, তিনি গ্রেপ্তার হন। শিল্পী সমিতির সাতবারের সাবেক সভাপতি আহমেদ শরীফের বিরুদ্ধে হয় চেক জালিয়াতির মামলা। ২০১৮ সালে তিনমাসের কারাদণ্ড ও একলাখ ৬৭ হাজার টাকা জরিমানা হয় তাঁর। তাদের সদস্যপদ স্থগিত করেনি মিশা-জায়েদের সমিতি।

অন্য শিল্পীদেরকে পুলিশি হয়রানি করানো, মিথ্যা মামলার ভয় ও ক্ষমতার দাপট দেখানো, তার কাজের সমালোচনাকারীর শিল্পী সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা, চলচ্চিত্রের উন্নয়ননীতির বিরুদ্ধে শিল্পীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ইত্যাদির অভিযোগে চলচ্চিত্রের ১৮টি সংগঠন মিলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জায়েদ-মিশাকে এফডিসিতে ‘বয়কট’ করে ২০২০ সালের ১৫ জুলাই। ওই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের অনেকেরই জায়েদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠন থেকে তাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তিনি গুরুত্বই দেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাপট দেখান।’

১৮টি সংগঠনের অনুষ্ঠানের পর ক্ষমতার দাপট দেখাতে এফডিসিতে পাল্টা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন হাতেগোণা কয়েকটি সিনেমার দ্বিতীয়, বা তৃতীয় সারির ‘নায়ক’ জায়েদ। এতে পর্দার খলনায়ক ডিপজল হুমকি দেন ১৮টি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে। তিনি বলেন, ‘আমি ডিপজল বাঁইচা থাকতে শিল্পী সমিতিরে টোকা দিবো, পৃথিবীতে এমন কোনো মায়ের পোলা (ছেলে) নাই।’ তার এ হুমকির প্রতিবাদ করেন চিত্রনায়ক ওমর সানি। ওই বছরের ২২ জুলাই নিজের ফেসবুকে সানি লেখেন, ‘ডিপজল, দুইটা (মিশা-জায়েদ) ফালতু ছেলের জন্য গলা ভাঙ্গার দরকার নাই।’

শিল্পী সমিতির ভোটার তালিকা থেকে ১৮৪ জনের নাম বাদ দিয়ে জায়েদ প্রচার করেন, এসব শিল্পীকে সদস্য থেকে সহযোগী সদস্য বানানোর প্রক্রিয়ায় অভিনেতা আলমগীরের স্বাক্ষর ছিল। বিষয়টি নিয়ে আলমগীর চ্যালেঞ্জ করেন। একটা অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জায়েদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলেন। তবে ওই মামলা তিনি দায়ের করেননি। ২০১৯ সালের চলচ্চিত্র দিবসের অনুষ্ঠানের খরচের জন্য ছয় লাখ টাকা ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের’ কাছ থেকে সরাসরি নেন জায়েদ। জাতীয় কমিটির মাধ্যমে গঠিত অর্থসংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরে তাকে বারবার চিঠি দিয়ে ওই টাকার হিসাব চাইলে তিনি দেননি। এমনকি কোনো সভাতেও উপস্থিত থাকেননি জায়েদ। আর্থিক অনিয়মের এমন আরো অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

শিল্পী সমিতির সদ্য সাবেক সভাপতি মিশা সওদাগর, জায়েদসহ কার্যকরী কমিটির বিরুদ্ধে ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। সমিতির ২৪০ সদস্যের চাঁদা নিয়ে রশিদ না দেওয়ার অভিযোগে গত ৮ জানুয়ারি এ জিডি হয়, এর নম্বর ৩৮৮। এতে বলা হয়, সমিতির বার্ষিক চাঁদা হিসাবে জনপ্রতি দুইহাজার ৪০০ টাকা চাঁদার রশিদ সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ‘দিচ্ছি দিচ্ছি’ বলে দিচ্ছে না।

এফডিসির ভেতরে মোট সাতটি সমিতির কার্যালয় আছে। এর মধ্যে একটা শিল্পী সমিতির। সাতটি সমিতি থেকে বিদ্যুৎ, পানির বিল ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ এফডিসির পাওনা কোটি টাকার বেশি। যা আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে এফডিসি। শিল্পী সমিতির কাছে এফডিসির মোট পাওনা প্রায় ১৮ লাখ টাকা। এফডিসি ও শিল্পীদের ‘উন্নয়নে সাংঘাতিক ব্যস্ত’ মিশা-জায়েদের সমিতিও নিয়মিত বিল শোধ করে না। অথচ ২০০৬ সাল থেকে লোকসান গুনতে গুনতে এফডিসির এখন অস্তিত্ব সংকটে।

নানাভাবে চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে জায়েদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ করলে প্রখ্যাত অভিনেতা আলমগীর এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে আজ মঙ্গলবার মুঠোফোনে বলেন, ‘শিল্পী সমিতির নির্বাচনের দিন আমাকে, আমাদের সেই পঞ্চাশ বছরের বাড়ি এফডিসিতে একদিনের জন্য আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই সেইদিন চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনের দিন তাদের কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমার পঞ্চাশ বছরের অভিনয় জীবনে এমন লজ্জাজনক ঘটনার মুখোমুখি হইনি।’ এসব বিষয় নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিনিসহ অন্যরা শিগগিরই আলোচনা করবেন বলে জানান।

ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেল থেকে কার্যকরী পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচনে বিজয়ী অভিনেতা ফেরদৌস বলেন- ‘গত কয়েক বছরে অনেক শিল্পীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখানো হয়েছে বলে জেনেছি, যা আগে কখনও হয়নি। সমিতিকে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থে।’

শেয়ার করুন