ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত। বিষয়টির শুরু থেকে কূটনৈতিকভাবে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখছে ঢাকা। তবে শুধু পর্যবেক্ষণ নয়। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের এখন ‘স্পষ্ট অবস্থান’ জানতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। মিত্র দেশগুলোকে পক্ষে টানতে তারা কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ করছেন ওই দুইদেশের ঢাকাস্থ দূতাবাসগুলো। তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোও। ঢাকার ওপর এ নিয়ে চাপ বাড়ছে। তবে বাংলাদেশ বা সরকার ‘বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর’ মধ্য থেকে কোনো পক্ষ বেছে নিতে চায় না।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো নিজের পক্ষে অন্যদেশের অবস্থান নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। যার যার অবস্থান দৃঢ় করতে, বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে পক্ষে ভেড়াতে কাজ করছে। এ তালিকায় আছে মস্কো, ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, বা ইইউভুক্ত দেশগুলো। এ বিষয়ে সেসব দেশের ঢাকার ‘স্পষ্ট অবস্থান’ জানতে চাওয়ার অর্থ হচ্ছে- বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। দেশগুলোর পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে স্পষ্ট হতে প্রকাশ্যে কূটনীতি চলছে। ঢাকায় নিযুক্ত দেশগুলোর রাষ্টদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মককর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। নিয়মিত যোগাযোগ চলছে।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকাস্থ ইইউ’র রাষ্ট্রদূত ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স’ বৈঠক করেন। তাঁরা ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমা ‘উদ্বেগ’ ও বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চান। ১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার বিকেলে। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক চলে। তাঁদের ‘উদ্বেগের’ বিষয়টি পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে জানান। এ সময় রাশিয়ার অবস্থানের বিষয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন ঢাকার ইইউ’র রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন ইস্যুর শান্তিপূর্ণ, টেকসই সমাধান চায় ঢাকা। তাঁদেরকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে চার্লস হোয়াইটলি কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। বলেন, ‘ইউক্রেনের বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলাম।’
বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন মত ও পথকে নিশ্চিত করেন। বলেন, ‘ইউক্রেনের সমস্যায় উদ্বেগ জানান পশ্চিমারা। তাঁরা চান পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। এ বিষয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সবদেশের কাছেই যৌথভাবে যাচ্ছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার ঢাকা ছাড়ার আগে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে কথা বলে গেছেন।’
বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নে পররাষ্ট্রসচিব বিদেশি দূতদেরকে বলেন, ‘এখানে জড়িত সবদেশই বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশ চায় না, বাংলাদেশকে এমন কোনো অবস্থানে ফেলে দেওয়া হোক, যেখানে বন্ধুদের মধ্যে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ চায়, সব পক্ষ যাতে সর্বোচ্চ সংযম দেখায়। এমন পদক্ষেপ নিতে, যেন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।’
- আরও পড়ুন >> আবারও বাড়লো এলপিজির দাম!
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মত ও পথকে বলেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের’ (র্যাব) কয়েক কর্মকর্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চলমান কিছু সমালোচনা। আগামী ২০২৩ সাল জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বছর। এসব বিবেচনায় চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ দৃষ্টি থাকছে বাংলাদেশের ওপর। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। এ অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি প্রভাবশালী দেশের আতশি কাচের নিচে থাকছে বছরজুড়ে। ২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য ‘কূটনৈতিকভাবে একটা কঠিন বছর’ হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন প্রশ্নে বাংলাদেশের ‘অবস্থান’ পরিষ্কার করতে সরকারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক দাবি। বিষয়টি সাময়িকভাবে হলেও বাংলাদেশকে কিছুটা ‘কূটনৈতিক চাপে’ ফেলতে পারে। এখনো পর্যন্ত সরকারের কূটনৈতিক অবস্থান ঠিক আছে। ‘সবার সঙ্গে সমান বন্ধুত্ব’ বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসিত ‘ভারসাম্যমূলক কূটনীতি’ দিয়ে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে পারবে।
গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ইউক্রেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। সংলাপ ও সহযোগিতার চেতনা বজায় রেখে এ সঙ্কট নিরসনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে এ সংকটের সমাধানের উপর অঞ্চল ও এর বাইরে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নির্ভর করে। যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।’
প্রসঙ্গত, বিদেশি সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও সিএনএনের ১ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত প্রতিবেদন মতে, ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন কেন্দ্র করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্ক হয়েছে। এতে মার্কিন দূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড বলেন, ‘ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য মোতায়েনের মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইউরোপ এ দশকে দেখেনি।’ রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বলা হয়, ইউক্রেনে সৈন্য মোতায়েনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘অস্বাভাবিক’ অস্বস্তিতে ভুগছে। ‘অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ’ করে আসছে।
ইউক্রেন পরিস্থিতি কেন্দ্র করে সংলাপের প্রস্তাবে রাশিয়া রাজি বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মঙ্গলবার রাশিয়ার লিখিত জবাবে বিষয়টি জানা যায়। এর আগে রাশিয়ার ইউক্রেন থেকে ন্যাটোকে সরানোর দাবি প্রত্যাখ্যান করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সফরে যান। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলোনস্কির সঙ্গে আলাপকালে রাশিয়ার সঙ্গে সংলাপে ‘কূটনৈতিক সমস্যা’র সমাধান ও ‘ব্যাপক রক্তক্ষয়ের ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা’ করবেন বলে তিনি সফরের আগে প্রতিশ্রুতি দেন।