তরুণ ছাত্রলীগ নেতাদের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়: মোকতাদির চৌধুরী
বেঁচে থাকলে আজ তাদের জীবনের হিসাবে যোগ হতো আরো এগারোটি বছর। তারুণ্যের বয়স পার করতেন। কেউ হতেন দেশের নামকরা চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা। কারো কারো অন্য পেশায় অবস্থান হতো সুনামের সিঁড়িতে। মেধার সঙ্গে সততা, দেশপ্রেমের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের সমন্বয়ে তারা দেশ, দশের সেবা করতেন। অথচ সময়ের শৃঙ্খল ভেঙে তারা চলে গেলেন আকাশের ওপারের জীবনে।
২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জাতির জনকের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তারা। মর্মস্পর্শী ওই ঘটনায় মৃত্যুর বুকে আশ্রয় নেওয়া ১২ জনের মধ্যে ১১জন ছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠন অন্ত:প্রাণ নেতা। সবার বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের উপনির্বাচনে বিশাল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী জাতির জনকের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গোপালগঞ্জে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে জননন্দিত নেতা মোকতাদিরের গাড়িবহর সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে নিহত হন ওই ১২ জন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
আধুনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উন্নয়নের রূপকার উবায়দুল মোকতাদিরের গাড়িবহর দুর্ঘটনার কবলে পড়ার সংবাদ মুহূর্তেই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব ও প্রিয়নেতা মোকতাদিরের খবর জানতে সারাবিশ্বের বাঙালির মধ্যে নানা উদ্বেগের জন্ম হয়। সবার প্রার্থনার হাত উঠে সৃষ্টিকর্তার বরাবর। তিনি যেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অহংকার মোকতাদিরকে সুস্থ রাখেন। সেদিন সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় রক্ষা পান তিনি।
বারোটি তাজা প্রাণের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বৃহত্তর কুমিল্লাসহ গোটা দেশে সেদিন নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন সবশ্রেণি পেশার মানুষ। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন অনেকে। চোখের দুইপাশ অশ্রুতে ভরে যায়। জাতির মেধাবী সন্তান, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে হারানোর শোকার্ত সেই দিন আজ। দিবসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে শোকার্ত অক্ষরে লেখা আছে। সেদিন প্রাণ হারানো ১২ জনকে প্রতিবছরের মতো আজও ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীসহ সারাদেশের মানুষ স্মরণ করবেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে, গভীর শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
নিহতদের কথা স্মরণ করে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী শোকবাণীতে বলেন, ‘এ দুর্ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক, দু:খজনক, হৃদয় বিদারক। দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি ১২ জন তাজা তরুণ প্রাণ ও জেলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে। তরুণ ছাত্রলীগ নেতাদের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা চিরকাল অপূরণীয় থাকবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। এতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী একলাখ ২৫ হাজার ১৪১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপিতা ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের রাজনৈতিক নেতা তিনি। জনমানুষের নেতা মোকতাদির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কবরের মাটি ছু্ঁয়ে ও তাঁর সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতির জন্য নতুন করে অবদান রাখার শপথ নেবেন- এটা স্বাভাবিক বিষয়। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ও জিয়ারত করেন তিনি।
গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সলিলদিয়ায় মোকতাদিরের গাড়িবহর দুর্ঘটনার শিকার হয়। একটি ট্যাংক লরির সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মাইক্রোবাসে তাঁর সফরসঙ্গী ১২ জন নিহত হন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী কখনো একসঙ্গে এতো মেধাবী মুখের মৃত্যু দেখেনি। তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের আগামীর সম্ভাবনার একটা অধ্যায়ের অকাল মৃত্যু হয়।
নিহত ছাত্রনেতাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কেন্দ্রস্থল বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। আজও ফুলে ফুলে ভরে ওঠবে তাদের স্মৃতিসৌধ। ভালোবাসার ফুল দিয়ে জনতা, জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদেরকে স্মরণ করবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার শোকাহত দিনটি পালনে আনুষ্ঠানিকতা অন্য বছরের তুলনায় কম। তাদের মৃত্যুর পর দিন গড়িয়ে, বছর পেরিয়ে সময় যাচ্ছে। কিন্তু তারা মানুষের হৃৎপিণ্ডের গভীরে আছেন।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন শোভন বলেন, ১১ ছাত্রলীগ নেতার স্মরণে শুক্রবার সকালে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ও শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
সেদিন প্রাণ হারানো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্বিত সন্তান ১২ জন হলেন- কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা মেহেদি আলম শান্ত (৩১), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সাবেক এজিএস আরিফুল ইসলাম বাবু (৩০), জেলা ছাত্রলীগের নেতা শওকত হোসেন লিয়েন (২৮), মোর্শেদ আলম (২৯), শাহজাহান রহমতুল্লাহ রুমেল (২৮), অ্যাডভোকেট জিয়াউল আমিন রিয়াদ (২৯), শেখ রায়হান উদ্দিন (২৮), হাফেজ আব্দুল্লাহ মাসুদ তানভীর (২৯), ইমরানুর রেজা ইমরান (২৮), নূরুল আসিফ চৌধুরী (২৮) ও মিজানুর রহমান (৩৫)। পরদিন ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মো. আলমগীর (২৮)। সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হয়ে সেদিন পঙ্গুত্ব বরণ করেন জেলা ছাত্রলীগের নেতা জাহিদ হোসেন পাভেল।