যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ চেয়েছে বিএনপিকে ‘ঘায়েল’ করতে। আরো ‘কোণঠাসা’ করে রাখতে। বিএনপি চেয়েছে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বের সরকারকে ‘সমালোচনার মুখোমুখি’ দাঁড় করাতে। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে ‘কুপোকাত’ করে, সরকারকে ‘চাপে ফেলে’ দাবি আদায় করা সহজ হবে। এমন পরিকল্পনা শুরুতেই ছিল বিএনপিতে। দুটি দলই বিদেশে আগে-পরে লবি করে। সেটা নিয়ে হঠাৎ করে রাজনৈতিক চালাচালিতে কোন দল এগিয়ে আছে? পিছিয়ে আছে কোন দল? রাজনীতির চালে কাবু হচ্ছে কোন দল- বিএনপি, না আওয়ামী লীগ?
বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ কোন দল কতো টাকায় করেছে, কী করেনি। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ইস্যুটি নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে বক্তৃতা করে সভাস্থল গরম করা যায়। তবে জনগণকে আগের মতো ‘বিভ্রান্ত’ করা সহজ নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লবি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ করা হয়ে থাকে। দেশটির প্রচলিত আইন অনুযায়ী। এতে মাসে কতো টাকায়, কতো বছরের জন্য চুক্তি ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
তা প্রকাশ করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। ইন্টারনেটের সুবাদে যে কোনো দেশের নাগরিক বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে সেসব তথ্য দেখতে পারেন। এমন অবস্থাতেও বিএনপি লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি ‘অস্বীকার’ করে আসছে ‘হাস্যকর’ উপায়ে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দলটির বিভিন্ন সময় চুক্তি হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করছে তা। কতো টাকায় নিয়োগ, টাকার বৈধ উৎস কী- এসব বিষয়ে সরকারবিরোধি দলটি চুপ। তবে গত পনেরো দিনের বেশি সময় ধরে এ ইস্যুতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লবি ইস্যুতে বিএনপি প্রথম চালেই ভুল করে। প্রথমে বিএনপি-জামায়াতের বিদেশে লবিস্ট নিয়োগে টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকার। বিষয়গুলোর তদন্ত করতে সংসদে দাবি জানান আওয়ামী লীগের কয়েক সংসদ সদস্য। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকারের অভিযোগ ও বক্তব্যের যৌক্তিক জবাব বিএনপি দিতে পারেনি। দলটি অভিযোগ করে- ‘আওয়ামী লীগই বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের নামে জনগণের অর্থ ব্যয় করছে।’ এর ‘সুষ্ঠু তদন্ত’ দাবি করে তারা। অথচ দল হিসেবে গত একযুগের বেশি সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ নিজের কার্যক্রম তুলে ধরতে বিদেশে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই বিএনপির শীর্ষনেতারা দাবি জানিয়ে বসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯৫ সালের ‘লবিয়িং ডিসক্লোজার’ আইন মেনে লবি প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য প্রকাশ করে। সেসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই-বাছাই করে জানা যায়, গত ১৩ বছরের মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশটিতে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দেয়নি। দলটির সরকার একাধিক ‘পিআরও’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কখনো কখনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। দল ও দলের সরকার আলাদা বিষয়। চারদলের জোট সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াত সরকারিভাবে অনেক লবিস্ট নিয়োগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা আরো কয়েকটি দেশে।
যুক্তরাষ্ট্রে মোট লবিস্টের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার। এর মধ্যে বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করে, এমন যারা নিবন্ধিত, তাদের সংখ্যা হচ্ছে ৮৭৫। এদের মধ্যে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছে, বিএনপি এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারছে না। সরকারের লবিস্ট নিয়োগের কথা স্বীকার করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলেন, ‘সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য লবিস্ট নিয়োগ দেয় ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে।’
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক আসছে অন্য কারণে। নিজের দলের কর্মকাণ্ড, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা ইত্যাদি তারা তুলে ধরেনি। এর বদলে বিএনপি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, জিএসপি সুবিধা বাতিল করতে আবেদন করে লবিস্টের মাধ্যমে। এসব বিষয়ে তথ্য প্রমাণ প্রকাশিত হয়ে পড়ায় ‘বেকায়দায়’ আছে দলটি।
আওয়ামী লীগ বলছে, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠিত হওয়ার বছর দুয়েক পর থেকে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের লক্ষ্যে’ লবি ফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসছে। দল দুটি ক্ষমতায় যেতে বিদেশি সরকারের ‘সমর্থনের লক্ষ্যে’ একের পর এক লবিস্ট নিয়োগ করে আসছে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশটির ‘মার্ক পার্সি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন ২০১৩ সালে। সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় বিএনপির খালেদা জিয়ার নামে একটি নিবন্ধ ছাপাতে চুক্তিবদ্ধ হয়।
খালেদা জিয়ার নামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ‘দ্যা থ্যাক্্সলেস রোল ইন সেভিং ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ, করাপশন অ্যান্ড স্টেলিং থ্রেটেন আ ওয়ানস ভাইব্রেন্ট নেশন’ শিরোনামে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান তিনি। নিবন্ধে জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবি জানান খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সরকার কেন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, সেটা জনগণের কাছে পরিষ্কার করবেন তারা। বিএনপি কেন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, সেটাও জনগণের কাছ তুলে ধরবেন ও বিচার দেবেন। যোগাযোগ করলে আওয়ামী লীগর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফারুক খান মত ও পথকে শনিবার বিকেলে বলেন, ‘আমাদের লবিস্ট নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য। বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো, দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। ’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিদেশ বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মত ও পথকে শনিবার মুঠোফোনে বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগ ইস্যুতে বিএনপি কোনো চাপের মুখে নেই। বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, একে চাপের মুখে ফেলা যাবে না। দেশে বিদেশে সরকার চাপের মুখে আছে।’