অজানা এক গন্তব্যের পথে হাঁটছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে, রক্ত ঝরছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশটিতে। প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোযোগ এখন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। এর আগে করোনাভাইরাস, বা কোভিড-১৯ মহামারির কবলে পড়ে বিশ্ব। বিভিন্ন দেশের সংকট থেকে তখন প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোযোগ চলে যায় নিজ দেশে করোনা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, টিকা সংগ্রহ ও উৎপাদনের দিকে।
এসব কারণে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও তাদেরকে নিজ দেশে ফেরানোর প্রশ্নে ভূমিকার দিকে বৈশ্বিক মনোযোগ কমে যায়। এতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ তাই আরো জটিল হয়ে উঠেছে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হচ্ছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার অব্যাহতভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও ক্রমাগতভাবে সংকটটি নানা কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ হারাচ্ছে। তাদেরকে নিজের দেশে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে গত কয়েক বছরে তেমন অগ্রগতি হয়নি। তাদেরকে উল্টো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশেই আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য দরকষাকষি করতে আগ্রহী।
এর মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। কোনো রক্তপাত ছাড়া জান্তা সরকার দেশটিতে ক্ষমতায় এলেও পরে দমনপীড়ন শুরু করে। সেনা অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সময় বিক্ষোভে, জান্তাদের দমনপীড়নে দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করলে মত ও পথকে বলেন, ২০২০ সালের শুরু থেকে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি। একদেশে করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে অন্যদেশের মানুষ ভাইরাসটির নতুন ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন। চলছে দুই বছর ধরে। এর আগে পুরো বিশ্ব এভাবে একসঙ্গে সংকটের মুখোমুখি হয়নি। করোনাকালে বিভিন্ন দেশের সংকট সমাধানে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক কার্যক্রম ও তৎপরতা স্বাভাবিক সময়ের মতো চলেনি। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কারণ, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, চীন, রাশিয়াসহ যেসব দেশের ভূমিকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেশে করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সেসব দেশের সবচেয়ে জরুরি কার্যক্রম হয়ে দাঁড়ায় করোনা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, মোকাবিলা ও জনগণকে রক্ষা করা।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিষয়ে যতটা পদক্ষেপ নেয়, প্রত্যাবাসন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া এখন পর্যন্ত তাদের তেমন তৎপরতা নেই। দেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় চীন নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে। ২০১৮ সাল থেকে দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় সরাসরি যুক্ত রয়েছে। চীনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা সত্ত্বেও কার্যত প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার কিছুই করেনি।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলার বিচারকার্যের ওপর থেকে সম্প্রতি আপত্তি তুলে নিয়েছে দেশটির ‘ছায়া সরকার’। যা জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকার। ক্ষমতায় থাকাকালে এ বিচারকাজে প্রাথমিক আপত্তি জানান মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানে তাঁর সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ‘ছায়া সরকার’ ওই আপত্তি তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারত, চীন, রাশিয়ারও উদ্যোগ নেই বললে চলে। বাংলাদেশ নিয়মিত কূটনীতির অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে এ সংকটের বিষয়ে জোরালোভাবে উত্থাপন করলেও সবাই চুপচাপ শুনছে, কোনো প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তাদের বেশি মনোযোগ রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সেই অর্থে মিয়ানমারকে রীতিমতো চাপে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো নেয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মহামারি পরিস্থিতি কেটে গেলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবার গতি পাবে। মিয়ানমারে তাদেরকে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের মধ্যেই সংকটের স্থায়ী সমাধান নিহিত- এ অবস্থানে অনড় বাংলাদেশ। কোনো অবস্থাতেই সংকটের বোঝা বেশিদিন বহন করতে পারবে না দেশ। আন্তর্জাতিক যত ফোরামে বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে, তার সবটিতে রোহিঙ্গা ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার সুলতান জয়নাল আবিদীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার সবচেয়ে বেশি শিকার বাংলাদেশ। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের ভূমিকা কম। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা সংকট কিছুটা হলেও বৈশ্বিক মনোযোগ হারিয়েছে। দেশটির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা কম। কারণ, বিভক্ত আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে না।’
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়। ২৫ আগস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকেন। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগের তিন দশকে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এ দেশে এসে অবস্থান করছিলেন। এতে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখে। পরে নানাভাবে আরও প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা আসেন। সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ।
জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সংকটকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এর সমাধানে প্রায় সাড়ে চার বছরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আইসিজেতে মামলা করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এ আদালত অবস্থিত।