ঢাকা-কলকাতার যৌথ সিনেমায় লতার গান নেই যে কারণে

হাসান শান্তনু

উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঢাকা-কলকাতার যৌথ প্রযোজনার কোনো ছবিতে গান নেই। তাঁর সমসাময়িক ও পরের প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই গেয়েছেন। লতার ছোট বোন আশা ভোঁসলেও গেয়েছেন ঢাকার কয়েকটি সিনেমায়। সেসব গানসহ ভারতীয় শিল্পীর গাওয়া সব গানই এ দেশের ও কলকাতার দর্শকের কাছে নন্দিত হয়। প্রয়াণের কয়েক বছর আগেও বিভিন্ন ভাষায় গানে সক্রিয় ছিলেন লতা। গেয়েছেন নতুন গান। দীর্ঘ সাত দশকের সঙ্গীত জীবনে বাংলাদেশের সিনেমায় তাঁর কণ্ঠে গান মাত্র একটি। আর কোনো গান কেন নেই? অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা কি বলছে?

১৯৮৩ সালে দেশের প্রখ্যাত নির্মাতা এহতেশাম বানান যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘দূরদেশ’। এতে তখনকার বোম্বে, ঢাকার তারকাদের সমাবেশ ঘটান তিনি। অভিনয় করেন শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, পারভিন ববি, রাজ বাব্বর, ববিতা। এটি হিন্দি ভাষায় ‘গেহরি চোট’ নামে মুক্তি পায় ভারতে। এ সিনেমার মধ্য দিয়ে যৌথ প্রযোজনাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যান এহতেশাম, বিশাল ক্যানভাসে ছবি নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন ঢাকার নির্মাতারা।

‘দূরদেশ’ তুমুল দর্শকনন্দিত হয় ঢাকা, কলকাতা, এমনকি বোম্বেও। ওই সিনেমার ‘যেও না সাথী, চলেছ একলা কোথায়, পথ খুঁজে পাবে না কো…’ শিরোনামের গানটি শ্রোতানন্দিত হয়। এ দেশের গীতিকারের লেখা গানটি হিন্দিতে হয় ‘রুক যা সাথি’। হিন্দি গানটিতে কণ্ঠ দেন লতা মঙ্গেশকর। গানটি নি:সন্দেহে কাল জয় করে এখনো নন্দিত, কালোত্তীর্ণ। তবে ‘দূরদেশে’ তাঁর কণ্ঠে বাংলা কোনো গান ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের পর লতা মঙ্গেশকর বাংলাদেশের মাত্র একটি সিনেমায় গান গেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মমতাজ আলি ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। সেই চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর ‘ও দাদাভাই’—জনপ্রিয় এ গান গেয়েছিলেন সুরের সারথি লতা মঙ্গেশকর। এটিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গাওয়া তাঁর একমাত্র গান।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার বেশ কয়েকটি সিনেমায় কলকাতার গান ব্যবহৃত হয়। তবে লতার গাওয়া কোনো গান ঢাকার সিনেমায় ব্যবহৃত হয়নি। সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত ‘তোমাকে চাই’ সিনেমায় কলকাতার ‘জীবন সঙ্গী’ সিনেমার গান সংযোজিত হয়। ‘তুমি আমায় করতে সুখি জীবনে, অনেক বেদনাই সয়েছ’ শিরোনামের গানটি অনুরাধা পাড়োয়াল ও অমিত কুমারের গাওয়া। যা দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। ‘জীবন সঙ্গী’ সিনেমার আরেকটি গান সংযোজিত হয় ঢাকার ‘মন মানে না’ সিনেমায়। ঢাকার ‘আশিক প্রিয়া’ সিনেমায় সংযোজিত বাপ্পি লাহিড়ী-অলকা ইয়াগনিকের ‘তুমি আমার সোনা সোনা গো’ গানটি মূলত কলকাতার। ‘স্বজন’ ও ‘আমার ঘর আমার বেহেশতের’ মতো সিনেমার সব গানই ভারতীয়।

আশির দশকে আশা ভোঁসলে ও হৈমন্তি শুক্লা ঢাকার সিনেমায় দুটি গান গেয়েছেন। একজনের কণ্ঠে ‘কাল সারারাত ছিল স্বপনের রাত’, আরেকজনের কণ্ঠে ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি, দেখ সোনালি আাকাশ’। একই সিনেমার জন্য গান দুটি গাওয়ানো হলেও ওই সিনেমা পরে নির্মাণ হয়নি। পরে গান দুটি আলাদা সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। প্রয়াত জাফর ইকবাল, ফারুক অভিনীত ‘বন্ধু আমার’ সিনেমায় গেয়েছেন আশা, বাপ্পি লাহিড়ী, মুন্না আজিজ, উদিত নারায়ণ। কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অনুরাধা পাড়োয়াল, পূর্ণিমা প্রমুখ গেয়েছেন কয়েকটি সিনেমায়। এ তালিকায় যোগ করা যায় না লতার নাম।

সিনেমাবোদ্ধাদের মতে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরও অপশক্তির বেশিদিন লাগেনি ভারতবিরোধি হুজুগ তুলতে। সংস্কৃতির মতো নিরেট বিনোদনের মাধ্যমটাতেও অন্ধকার শক্তি ধর্মের মোড়ক সেঁটে দিয়ে ‘বিধর্মীদের আগ্রাসন’ থেকে ঢাকার সিনেমাকে ‘রক্ষার’ শ্লোগান তোলে! কলকাতার সঙ্গে ঢাকার যৌথ সিনেমা নির্মাণে চলচ্চিত্রের মতো অগ্রসর সমাজের একটা অংশও তখন ‘আগ্রহ’ বোধ করেননি। আশির দশকের দিকে কেউ কেউ সিনেমা বানালেও লতা পর্যন্ত পৌঁছানোর সময়, সুযোগ নানা কারণে হয়নি।

তাঁরা বলেন, ঢাকার সিনেমায় ভারতীয় শিল্পীর কণ্ঠে গান সংযোজিত হলে প্রতিবার একই অভিযোগ ওঠে, কলকাতা, বলিউডের সিনেমায় এ দেশের শিল্পীদের নেওয়া হচ্ছে না। ভারতীয়দের কব্জায় চলে যাচ্ছে ঢাকার সিনেমাপাড়া। অথচ সত্য হচ্ছে, ঢাকার যতো শিল্পী বলিউডের সিনেমায় গানের সুযোগ পেয়েছেন, বলিউডের শিল্পীরা ততো গান গাওয়ার সুযোগ পাননি ঢাকার সিনেমায়। বিষয়টা নিয়ে এ পর্যন্ত দেশের সংবাদমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ আলোচনা হয়নি।

ভারতীয় শিল্পীদের গাওয়া অল্প কয়েকটা গান বাদে বেশিরভাগই ঢাকা-কলকাতার যৌথ প্রযোজনার সিনেমা। অথচ এ দেশের শিল্পীদের গাওয়া বলিউডের একটা সিনেমাও যৌথ প্রযোজনার নয়। বলিউডের সিনেমায় পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশের শিল্পীদের গান গাওয়া শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে গীতা দত্তকে দিয়ে। এরপর গেয়েছেন রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, মিতালি মুখার্জি, জেমসরা। সংখ্যার দিক থেকেও বলিউডের সিনেমায় ঢাকার শিল্পীদের গান বেশি।

উপমহাদেশের বরেণ্য শিল্পী কিশোর কুমারের সঙ্গে সাবিনা ইয়াসমিনের দ্বৈতকণ্ঠে একটা গান আছে ‘অবিচার’ সিনেমায়, এটা আলোচনার বিষয় হয়নি। সিনেমাটির পরিচালক ভারতীয় নাগরিক শক্তি সামন্ত (যদিও যৌথ পরিচালনায়), এটাই নিন্দার বিষয়ে পরিণত হয়! পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভাষাগত মিলের কারণে এ দেশের কণ্ঠশিল্পীরা টালিউডপাড়ায় অনেক আগে থেকে গান গাইছেন। হিন্দি গানে ঢাকার শিল্পীদের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে মূল বাধা ভাষাগত পার্থক্য। হিন্দি ও উর্দুর ভাষাগত আত্মীয়তার কারণে শুরু থেকে বলিউডের গানে ঢাকার তুলনায় পাকিস্তানি শিল্পীদের উপস্থিতি বেশি।

হাল আমলের শিল্পীরাও ঢাকার যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় গান গাইছেন। আকাশ সেনের বাংলাদেশের ২০১২ সালে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ ছবিতে কৈলাশ খেরের গাওয়া ‘কে কাহার’ দিয়ে শুরু। এরপর ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’য় করেন ‘ঢাকার পোলা’, ‘হোয়াট ইজ লাভ’ এবং ‘সাজনা ভালোবাসা ভোলা যায় না’ গানগুলো। ‘স্বপ্ন যে তুই’ ছবির আলোচিত গান ‘তোর চোখেতে চেয়ে’সহ তিনটি গান তাঁর করা। ‘মোস্ট ওয়েলকাম-টু’ ছবিতেও সমানসংখ্যক গান। এরপর ‘চিকেন তন্দুরি’।

কলকাতা-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিতে ‘বাংলাদেশের মেয়ে’ গানটিও তাঁর করা। ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’, ‘অগ্নি-২’, ‘অঙ্গার’, ‘মেন্টাল’, ‘পোড়ামন-২’ ছবিতেও রয়েছে তাঁর গান। জাজের প্রযোজনার বেশ কয়েকটি ছবিতে রয়েছে তাঁর গান। ‘আমি তোমার হতে চাই’ শিরোনামে বাংলাদেশের সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বলিউডের শিল্পী অ্যাশ কিং।

‘টুকরো প্রেমের গল্প’ শিরোনামের একটি গানে কণ্ঠ দেন আসিফ আকবর ও কলকাতার মোনালি ঠাকুর। ‘আমি নেতা হবো’ ছবির ‘চুম্মা’ গান দিয়ে বেশ ভালোই সাড়া ফেলেন কলকাতার শিল্পী জেমি ইয়াসমিন। ‘চোরাবালি’ ছবিতে গেয়েছিলেন অনুপম রায়। ‘অগ্নি’ ছবিতে স্যাভির সুরে নেহা কাক্কর গেয়েছিলেন ‘ম্যাজিক মামনি’। ‘রক্ত’ ছবিতে গেয়েছিলেন কনিকা কাপুর। এ ছাড়াও শানসহ বেশ কয়েকজন এ সময়ের ভারতীয় শিল্পী বাংলাদেশের বহু ছবিতে কণ্ঠ দেন।

শেয়ার করুন