মৃত্যুর আগে লতার কণ্ঠে যে গান শুনতে চেয়েছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা

হাসান শান্তনু

কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর
কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। ফাইল ছবি

যুদ্ধাহত এক মুক্তিযোদ্ধা। একদিকে জীবন, অন্যদিকে মৃত্যু, মধ্যে অবস্থান তাঁর প্রাণের। ভারতের একটা হাসপাতালে চিকিৎসারত। স্বদেশকে হায়েনামুক্ত করতে আরো কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার আর্তি চোখে, মুখে। উচ্চারণে বেশ জড়তা। একদিন চিকিৎসকদের জানালেন, প্রিয়শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সরাসরি গান শুনতে চান। প্রাণের কী উদ্ভট কাঙ্গালপনা! দেশমাতৃকার জন্য লড়ে বীরত্বের মৃত্যুর আগের সাধ!

ঘটনাটি ১৯৭১ সালের। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ চলছে। রণাঙ্গনের ওই যোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হলে এক পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য তাঁকে নেওয়া হয় ভারতের একটা হাসপাতালে। সেখানে শয্যায় শুয়েই তিনি জানান লতার গান শোনার অদম্য ইচ্ছের কথা। কীভাবে যেন লতা মঙ্গেশকরের কাছেও খবর পৌঁছায়, মুক্তির জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের এক শ্রেষ্ঠসন্তান রণাঙ্গনে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছে লতার কণ্ঠে গান শোনা।

universel cardiac hospital

পরদিনই লতা ছুটে যান ওই হাসপাতালে। বরেণ্য, নন্দিত শিল্পীকে এতো কাছ থেকে দেখে আহত বীরের চোখে অপার বিস্ময়। শিয়রের পাশে বসে তাঁর কপালে হাত বুলিয়ে লতা গান শোনাচ্ছেন। গান শেষে লতা টের পান, যোদ্ধার শরীর ঠাণ্ডা, নিথর। চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, গান শুনতে শুনতেই ওই মুক্তিযোদ্ধার চিরবিদায় হয় পৃথিবী থেকে। লতার চোখও ভিজে যায় অশ্রুতে।

যে দেশের মাটি ছুঁয়ে দিলে শহিদ, রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র রক্তে ভিজে যায় হাতের সব আঙ্গুল, সেই দেশের এক শহিদের চোখ চিরতরে নিভে আসে লতার গান শুনে। বিশুদ্ধ আবেগের গান। গানটি ছিলো- ‘লাগ যা গালে, কি ফির ইয়ে হাসিন রাত হো না হো, শায়েদ ফির ইস জনম ম্যা মোলাকাত হো না হো’। এ জীবনে আর দেখা হয়, কী না হয় (শায়েদ ফির ইস জনম ম্যা মোলাকাত হো না হো)- ওই শহিদ কি নিজের দেশটার সঙ্গে আর দেখা হয়, কী না হয়- এমনটাই ভাবেননি শেষ নি:শ্বাসের আগে?

মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। তখনো তিনি ভারতীয় হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ওই স্মৃতির কথা বলেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাতকারেও তিনি একাধিকবার ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশে আসার ঘটনা নিয়ে লতা টুইটারে একটি বার্তা প্রকাশ করেছিলেন। সে বার্তায় তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসে সংগীত পরিবেশনের স্মৃতিচারণা করেন। টুইটটি তিনি করেন ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।

টুইটারে লতা ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি লেখেন, ‘নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য ভারতীয় শিল্পীরা এগিয়ে আসেন। সে সময় লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বাংলাদেশের জন্য সংগীত পরিবেশন করেন।

লতা মঙ্গেশকর পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গানও গেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মমতাজ আলী ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রে সলিল চৌধুরীর সুরে প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী ‘ও দাদাভাই’—জনপ্রিয় এই গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এটিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গাওয়া লতা মঙ্গেশকরের একমাত্র গান।

২৭ দিনের লড়াই শেষ করোনার কাছে হেরে গেলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। ৬ ফেব্রুয়ারি, রোববার সকালে তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের রেখা মুছে দিয়ে অমরত্বের পথে পাড়ি জমান। ভারতের কোকিলকন্ঠী’ লতার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

শেয়ার করুন