দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র!

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

বিএনপি ও তার সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। যদিও এই নির্বাচনের নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের শেষের দিকে। এত আগে থেকে বিএনপি ও তার মিত্রদের দৌড়ঝাঁপের কারণ হচ্ছে, দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তহবিল তছরুপের দায়ে দণ্ডিত।

বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায় শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত হয়ে নিজ বাড়িতে আছেন এবং নিজের পছন্দসই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭৭ বছর এবং তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে আছে লিভার সিরোসিস, দাঁতের সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ। হাঁটাচলাও তাঁর জন্য সমস্যা।

universel cardiac hospital

কয়েক দিন আগে বিএনপির একজন দায়িত্বশীল পণ্ডিত খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে সবার কাছে হাসির পাত্র হয়েছেন। দলের মহাসচিব পিছিয়ে থাকবেন কেন? তিনি দলের দণ্ডিত ও বর্তমান পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে শিশু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা-ই হোক, খালেদা জিয়া এ দেশেরই একজন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা। তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন। তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করি। ৮১ দিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি গত বুধবার কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেন। বিএনপি ও তার মিত্ররা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে যে অসুস্থ রাজনীতির অবতারণা করেছিলেন তাঁর এই বাড়ি ফেরায় আপাতত তা কিছুটা হলেও বন্ধ হয়েছে।

যে দলটির জন্ম অস্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় থেকে, সেই দল দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে। এটা অনেকটা মুসলিম লীগ হওয়ার পথে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার মতো। তা যাতে না হয় সে ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতারা তাঁদের দেউলিয়া সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে দীর্ঘদিন দেশে ও দেশের বাইরে জোরালো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে নিত্যনতুন সঙ্গীও জুটছেন। সর্বশেষ যুক্ত হলেন আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের সফল অর্থমন্ত্রী, আততায়ীর হাতে নিহত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া। তাঁর প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দেশের বিরুদ্ধে সেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে বিএনপির নালিশ করা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় নালিশ করার জন্য এমন অনেক বৈধ প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের বলা হয় লবিস্ট ফার্ম। যে সবচেয়ে বেশি ফি দেয়, এরা তার হয়ে সেই দেশে ব্যবসা পেতে বা অন্য কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সেই দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে নালিশ বা সুপারিশ করে। এখানে নীতিনৈতিকতার কোনো ব্যাপার নেই। বিএনপি বাংলাদেশে তাদের কথায় ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করে সেই দেশে তাদের পক্ষে ওকালতি করার জন্য লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী দালিলিক প্রমাণসহ এই তথ্য জাতীয় সংসদে জানালে বাংলাদেশে এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রথমে তারা তা অস্বীকার করলেও যখন বলা হলো এসব দলিল যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইটেই পাওয়া যায়, তখন বিএনপির মহাসচিব স্বীকার করেন তাদের পক্ষ হয়ে তাদের কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী এই কাজটি করেছে এবং অনুরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র যেন বাংলাদেশকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, তারা অর্থ সহায়তা বন্ধ নয়, পর্যালোচনার কথা বলেছে।

দেশের পক্ষে এ ধরনের লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করা দোষের কিছু নয়, তা যদি হয় দেশের স্বার্থে। যেসব দেশে শিশুশ্রম ব্যবহৃত হয়, যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল ২০০৩ সালে। এতে বাংলাদেশের উঠতি তৈরি পোশাকশিল্প মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সমস্যায় পড়েছিল বাংলাদেশ। খালেদা জিয়া সরকার তখন লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। তবে বাংলাদেশের নিয়োগ করা সেই লবিস্ট ফার্ম তাদের কাজে ব্যর্থ হয়।

খালেদা জিয়া ২০১৩ সালে লন্ডনভিত্তিক একটি লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন টাইমসে তাঁর নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি আবেদন করেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে’ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সব রকমের বাণিজ্য ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা যেন বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি সংসদে উঠলে তা তাঁর লেখা নয় বলে জানান। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে যে সামান্য পরিমাণের শুল্ক সুবিধা দিত, এরপর তা বন্ধ করে দেয়। নিজের পায়ে কুড়াল মারা আর কাকে বলে। এ নিয়ে দেশে তোলপাড় শুরু হলে খালেদা জিয়ার একসময়ের আইনমন্ত্রী বর্তমানে প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ সংসদে জানিয়ে দেন ওই প্রবন্ধটি তাঁরই লেখা।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এই বলে যে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এতে বিএনপি ও তার সতীর্থরা বেজায় খুশি। র‌্যাব গঠিত হয়েছিল খালেদা জিয়ার শাসনকালে ২০০৩ সালে। প্রথম কয়েক মাসে তারা ৪৩ জন মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে এই বলে যে তারা সবাই সন্ত্রাসী। এই হত্যাকাণ্ডের যেন কোনো বিচার করা না যায় সে জন্য খালেদা জিয়ার আইনমন্ত্রী সংসদে একটি দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি আইন পাস করেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তখন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ২০১৫ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় দেশের উচ্চ আদালত এই আইন বাতিল করে দেন।

র‌্যাবের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে অনেক নিরাপদ। এখন জঙ্গিবাদ, অস্ত্র চোরাচালান, অবৈধভাবে মাদক ও মানবপাচার বন্ধ হয়েছে। তাদের দক্ষতার কারণে অনেক পুরনো মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে কম করে হলেও এক হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। তাহলে তাদের এসব বাহিনী কি নিষিদ্ধ করে দিতে হবে? মোটেও না। প্রতিটি দেশেই এই রকম এলিট ফোর্স আছে। চেষ্টা করতে হবে এই রকম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং দেশের ফৌজদারি আইনকে যুগোপযোগী করে তোলা। বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনের ফাঁক গলে কত দুর্বৃত্ত আর সন্ত্রাসী যে বের হয়ে যায় তার হিসাব করা কঠিন।

এবার আসি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলের যুদ্ধ ঘোষণা প্রসঙ্গে। খালেদা জিয়ার শাসনকালে, ২০০৩ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া হবিগঞ্জে নিজ জেলায় সন্ত্রাসীদের গ্রেনেডে গুরুতর আহত হলেন। তিনি তখন সংসদ সদস্য। তাঁকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় আনার প্রয়োজন ছিল। খালেদা জিয়া তা দিতে অস্বীকার করেন। তিনি পথিমধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই উচ্চশিক্ষিত ও আপাতমার্জিত সন্তানের খায়েশ হয়েছে তিনি রাজনীতিতে এসে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করবেন। ২০০৮ ও ২০১৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের চেষ্টা করলেন। বিফল হয়ে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে যোগ দিলেন। পরে গণফোরামকে দ্বিখণ্ডিত করার কাজে লিপ্ত হলেন। ২০১৮ সালে তিনি নাগরিক ঐক্যের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ মার্কা নিয়ে হবিগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। সেই ব্যক্তি এখন আওয়ামী লীগ হটাও আন্দোলনের একজন সৈনিক। কয়েক দিন আগে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন এই যে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তিনি তাতে বেশ উৎফুল্ল। আশা করছেন, এ রকম আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে। এ জন্য তিনি ও অন্যরা কাজ করছেন। পিতার রক্তের সঙ্গে বেইমানির উদাহরণ আর কী হতে পারে!

সম্প্রতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি আবার বিএনপির স্বঘোষিত উপদেষ্টা, তিনি আবিষ্কার করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া নাকি ভুল হয়েছে। কাদের মোল্লা নাকি একাত্তরে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন আর সাঈদী শিশু ছিলেন।

প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচনে বিএনপি কাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখিয়ে অগ্রসর হবে? যে দুজন ঝুলিতে আছেন দুজনই দণ্ডিত। একজন আবার মারাত্মক অসুস্থ। আর যাঁরা বিএনপির সঙ্গে নতুন জুটেছেন তাঁদের বুঝতে হবে অনেক পুরনো পাগলে ভাত পায়নি। তবে চেষ্টা করতে দোষের কিছু নেই।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন