ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত প্রশ্নে বাংলাদেশ কোন পক্ষে – এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে ‘অবস্থান স্পষ্ট’ করতে বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেহি আইনের’ আওতায় এ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অনুদান অব্যাহত রাখতে হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও এখন কৌশল বদলাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সম্মতি জানাতে হবে।
এসব প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে বন্ধুরাষ্ট্রগুলো থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারণসহ দেশীয় কয়েকটি ইস্যুতে ঢাকার প্রতি চাপ বাড়ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করে এখনো প্রকাশ্যে কোনো দেশের প্রতি অবস্থান জানায়নি। বিষয়টি আরো গড়ালে, দেশগুলো সংঘর্ষ ও যুদ্ধ জড়ালে ঢাকা ‘অবস্থান স্পষ্ট’ করার পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মত ও পথকে বলেন, গত বছরের শেষদিকে, ১০ ডিসেম্বর ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের’ (র্যাব) কয়েক কর্মকর্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। যা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কৌশল। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চলমান কিছু সমালোচনাও আছে। আগামী ২০২৩ সাল জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বছর। এসব বিবেচনায় চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ দৃষ্টি থাকছে বাংলাদেশের ওপর।
তারা মনে করেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনায় বৈশ্বিক পরিসরে আগের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশকে তারা পাশে চাচ্ছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তাই প্রভাবশালী দেশের আতশি কাচের নিচে থাকতে পারে চলতি বছরজুড়ে। ২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য ‘কূটনৈতিকভাবে একটা কঠিন বছর’ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের সংশোধিত লেহি আইন ও এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন চাপের সৃষ্টি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো মত ও পথকে জানায়, ২০২১ সালে লেহি আইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সংশোধনী এনেছে। সংশোধনী অনুযায়ী সহায়তা নেওয়া কোনো দেশকে বিষয়টি মেনে চলতে লিখিত চুক্তি করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। নতুন সংশোধনী ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্বের সব দেশের জন্য কার্যকর হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া।
যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশোধিত আইন অনুযায়ী চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে সময় বেঁধে দেয়। প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া শেখ হাসিনার দক্ষ কূটনীতির কারণে বাংলাদেশ এ বিষয়ে বিশেষ কূটনৈতিক ছাড় পায়। বাংলাদেশের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র সময়সীমা বাড়ায়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ আইন কার্যকর হলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে চূড়ান্ত মতামত জানায়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সংশোধিত লেহি আইন নিয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছে। ফলে আইনটির আওতায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অনুদান এখনো অব্যাহত আছে। এ আইনের আওতায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রথম সরকারের আমল থেকে অর্থাৎ ১৯৯৮ সাল থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে। গত ২৫ বছর ধরে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনটি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব। তাই এতে অন্য দেশের মতামত যুক্ত করার কোনো সুযোগ আগের মতো নেই।
অন্যদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো নিজের পক্ষে অন্যদেশের অবস্থান নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। যার যার অবস্থান দৃঢ় করতে, বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে পক্ষে ভেড়াতে কাজ করছে। এ তালিকায় আছে মস্কো, ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, বা ইইউভুক্ত দেশগুলো। এ বিষয়ে সেসব দেশ ঢাকার ‘স্পষ্ট অবস্থান’ জানতে চাচ্ছে।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন মত ও পথকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার বিষয়টিতে জড়িত সবদেশই বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশ চায় না, বাংলাদেশকে এমন কোনো অবস্থানে ফেলে দেওয়া হোক, যেখানে বন্ধুদের মধ্যে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’