ভোক্তাকে ভোগাচ্ছে ভোজ্যতেল!

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোজ্যতেল

ভোক্তাকে বেশ ভোগাচ্ছে ভোজ্যতেল। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের পেছনে দফায় দফায় খরচ বাড়ছে মানুষের। এক বছর আগে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ পাম তেল পাওয়া যেত, বর্তমানে সেই পরিমাণ তেল কিনতে খরচ হচ্ছে ১৩৭ টাকা। এই হিসাবে খরচ বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গত রোববার এই তেলের দাম এক লাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগেই কিছু কোম্পানি বেশি দর নির্ধারণ করে তেল বাজারে ছেড়েছে। সেই হিসাব কষলে এক বছরেই দাম বাড়ার হার গিয়ে ঠেকবে প্রায় ৫০ শতাংশে।

দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ পাম তেল খান। যে পরিবারে মাসে পাঁচ লিটার তেল লাগে তাদের এ বাবদ খরচ বেড়েছে ২০০ টাকা। করোনার এই দুঃসময়ে অধিকাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারের মাসিক আয় উল্টো কমেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। যার ৯৯ শতাংশ আমদানিনির্ভর। ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ খোলা তেল। এর মধ্যে পাম তেল ৫০ শতাংশ। বাকিটা খোলা সয়াবিন। রান্না ছাড়াও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়। পাম তেলের মতো খোলা সয়াবিন তেলের দামও এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৭ শতাংশ। আর বোতলজাত তেলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ২০২১ সালে বেশ কয়েকবার ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারবার বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমবে, তখন দেশের বাজারেও কমানো হবে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমায়নি। এই বছরের শুরুতে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলে সরকার তাতে সায় না দিয়ে কিছুদিন সময় নেয়। তবে ব্যবসায়ীরা সরকারের কথা শোনেনি। বরং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মৌন সম্মতিতে খোলা তেলের দাম তাদের সুবিধা অনুযায়ী বাড়িয়ে নিয়েছে। অবশেষে রোববার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে সাত টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা এবং পাম তেলে লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাজার বিশ্নেষকরা বলছেন, ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার যেভাবে ব্যবস্থাপনা করা দরকার, বাংলাদেশে তা হয় না। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ এ পণ্যটির ব্যবসা করছে। সরকার ওইসব কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে পাম তেলে শুল্ক্ক প্রত্যাহার করা যেতে পারে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও বাড়ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। যে কারণে ব্যবসায়ীরা বেশি দাম নির্ধারণে বাধ্য হচ্ছেন।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াটাই ভুল। সরকারের উচিত প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা। সরকার তা না করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে সরকার সহায়তার হাত বাড়াতে পারে। কর কমাতে পারে। সে ক্ষেত্রে করছাড়ের সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছাবে- তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আক্তার তসলিম বলেন, বাংলাদেশে দাম কমানোর সুযোগ আছে আমদানি পর্যায়ে যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নেওয়া হয় তা কমানোর মাধ্যমে। ভারতে সয়াবিন আমদানিতে সব মিলিয়ে ৫ শতাংশ শুল্ক্ক দিতে হয়। বাংলাদেশে দিতে হয় ১৫ শতাংশ। সরকার এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ছাড় দিলে লিটারে দাম ১২ থেকে ১৪ টাকা কমে যাবে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ভোজ্যতেলে শতকরা হারে ভ্যাট নির্ধারণ না করে ট্যারিফ ভ্যাট নির্ধারণ করলেও দাম কিছুটা কমবে।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, শুল্ক্ক ছাড় দেওয়া হলে সেই সুবিধা যে জনগণ পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি হয়। দেশে এ পণ্যটির ব্যবসা করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। কয়েক বছর আগে এ ব্যবসায় ইলিয়াস ব্রাদার্স, নূরজাহান গ্রুপ, এস এ গ্রুপ, রুবায়েত ভেজিটেবলস, সুনশিং এডিবল অয়েল থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে।

শেয়ার করুন