পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে গত দুই মাসেরও কম সময়ে বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমরা অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) পেয়েছি। তর্ক-বিতর্কের মধ্যে ইসি গঠন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে; জাতীয় সংসদে আলোচনা, এরপর পাস ও সবশেষ প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। আশার কথা, গত দুইবারের মতো নয়, এবারের সার্চ কমিটি আইনের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। একে ঘিরে জনপ্রত্যাশাও তাই গত দুইবারের চেয়ে ভিন্নরকম। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা, সন্দেহের দোলাচল থাকলেও বা গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কারো কারো প্রশ্ন থাকলেও নিরপেক্ষ ও কার্যকর ইসি গঠনে সার্চ কমিটি কী ভূমিকা রাখে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বাছাই করা সার্চ কমিটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ কীভাবে কমিটি মোকাবেলা করছে, জাতির দৃষ্টি এখন সেদিকে। সবাই তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে। শক্তিশালী ইসি গঠন প্রশ্নে আর সার্চ কমিটির যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব ছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প নেই। কারণ, বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার বাইরে যাওয়ার সুযোগ কারো নেই।
সার্চ কমিটির শক্তিশালী ভূমিকা, ইসি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, নাগরিক সমাজের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া ও সম্মিলিত সহযোগিতায় সব বিতর্কের সলিলসমাধি সম্ভব। কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাবের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাম চাইবে। একাধিক রাজনৈতিক দল বলছে, তারা কমিটির কাছে কোনো নামের তালিকা দেবে না। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত এতে আটকে থাকলে বিতর্কের একটা উৎস রয়ে যেতে পারে। দলগুলোর তাই কমিটির কাছে অবশ্যই নাম প্রস্তাব করা উচিত।
সার্চ কমিটি গঠিত হওয়ার পর আমরা সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখেছিলাম, সদ্য প্রণীত ইসি আইন কাজে লাগালে কমিটির পক্ষে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে যোগ্য, অভিজ্ঞ, সৎ ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদের ইসি নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা গণতন্ত্র, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না- এটাও দলগুলোকে মনে রাখতে হবে। আমরা এ কথা দুইপক্ষকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই গণতন্ত্রের স্বার্থে।
একইসঙ্গে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের নাম সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের যে দাবি উঠেছে, আমরা সেটাকে সমর্থন করি। এতে রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজ মতামত ব্যক্ত করতে পারবে। রাষ্ট্রপতির পক্ষেও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া তখন সহজ হতে পারে। ২০১২ সালে ইসি গঠনের আগে গঠিত সার্চ কমিটি ১০ জনের তালিকা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে জমা দিয়ে জনসমক্ষে নাম প্রকাশ করেছিল। সে তালিকা থেকেই পাঁচজনকে ইসিতে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
এবারের সার্চ কমিটির উচিত হবে, তাদের সামনে জনদাবি ও জনপ্রত্যাশা যেগুলো আছে, সেগুলোকে যথাযথ কাজে লাগানো। স্বাধীন ইসি গঠন হলে শুধু গত প্রায় দুইমাস ধরে চলা বিতর্ক নয়, আরো আগে থেকে চলা সব বিতর্কের অবসান হতে পারে। কারণ, ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে।
ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গত রোববার, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বৈঠক করেছে। আজ ৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার বিকেলে দ্বিতীয় বৈঠক করার কথা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সুশীল সমাজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করবে। যেসব নাম আসবে, তা যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করা হবে। সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুই এবং চারজন কমিশনারের জন্য আটজন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে কমিটি।
প্রজ্ঞাপনে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নাম প্রস্তাবের কথা বলা হলেও বর্তমান ইসির মেয়াদ বিবেচনায় সার্চ কমিটির হাতে ততোদিন সময় নেই। কমিটির প্রধান জানিয়েছেন, এর মধ্যেই সম্ভাব্য নাম সুপারিশ করা সম্ভব। এ আত্মবিশ্বাস নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য সার্থক হবে।