বিপন্ন আদিবাসী মাতৃভাষা

দেলোয়ার জাহিদ

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা
সংগৃহীত ছবি

ভাষা সংরক্ষণ ও মাতৃভাষার মান উন্নয়নের ওপর কখনো গুরুত্বারূপ করা হয়নি তা হোক বাংলাদেশ অথবা মানবাধিকারের দেশ বলে খ্যাত কানাডায়। বহুসংস্কৃতিবাদ ও স্বাক্ষরতা নিঃসন্দেহে যে কোন দেশের একটি রাজনৈতিক অঙ্গিকার, আর এর সাথে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির চরিত্র.. যার কারণে কখনো কখনো আমাদের রাষ্ট্রকে ও আপসকামিতার আশ্রয় নিতে হয়। মায়ের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সচেতনতা প্রসারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২২ হোক একটি মোক্ষম উপলক্ষ। প্রতিযোগি নয় বরং সম্পূরক শক্তি হিসাবে অন্যান্য সংগঠনের সাথে একাত্ন্য হয়ে দেশে বিদেশে কাজ করার মাধ্যমে ভাষা শহীদদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবে বিশ্ববাসী ।

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের কোথাও না কোথাও গড়ে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি ভাষা মারা যায় – এবং কানাডার অনেক আদিবাসী ভাষা ঝুঁকির মধ্যে বিবেচিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে ইউএন এডুকেশন, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (UNESCO) আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতা উন্নীত করার জন্য বিপন্ন ভাষার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ভাষা বছর চালু করেছে। “ভাষা গুরুত্বপূর্ণ!” নতুন আন্তর্জাতিক বছরের স্লোগান। ইউনেস্কো বলেছে যে বিশ্বজুড়ে বহু ভাষা কথ্য রয়েছে- আনুমানিক ৬৭০০টি; তবে দীর্ঘমেয়াদে তাদের অর্ধেকেরও বেশি বিলুপ্ত হতে পারে। কানাডিয়ান হেরিটেজ বিভাগ বলেছে যে এটি বছরটিকে চিহ্নিত করার জন্য কোন অফিসিয়াল ইভেন্ট বা কার্যক্রমের অর্থায়ন বা আয়োজন করছে না।(সিবিসি নিউজ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০০৮)

ইউনেস্কোর মতে আদিবাসী কয়েক ডজন ভাষা কানাডায় মৃত্যুর অত্যন্ত কাছাকাছি রয়েছে, কানাডা বিশ্বের বিপন্ন ভাষার দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ নম্বরে আছে. আরও আছে. ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র.. আদিবাসী ভাষার ইতিহাস এবং জাতি হিসেবে যে তাদের কথা বলতে সংস্কৃতির সংযোগ তা পরিবেশন করা. চারু ও কারুশিল্পকরণ, সাংস্কৃতিক ধর্মানুষ্ঠান ভাষার ওপর নির্ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে তা হস্তান্তর করা, এবং যখন একটি ভাষা হারিয়ে যায়, সে সাথে ভাষার সাথে যুক্ত ঐতিহ্যের অংশ ও হারিয়ে যায়.. .কানাডায়, নিরাপদ বলে বিবেচিত কোনো আদিবাসী ভাষা নেই। বর্তমানে কানাডায় কথিত আদিবাসী ভাষাগুলি বিপন্নতার চার ডিগ্রির মধ্যে পড়ে। (ইউনেস্কো; নরিস ২০১৩) বলা চলে ৪টি আদিবাসী ভাষার মধ্যে ৩টিই বিপন্ন। ক্রি, ওজিবওয়া এবং ইনুক্টিটুটের মতো বড় ভাষা গোষ্ঠীগুলি এখনো কার্যকর, তরুণ থেকে বয়স্ক পর্যন্ত যাদের অন্তত ২৫, ০০০ বক্তা বা ভাষাবাসী রয়েছে, । তবে সব ভাষা, যেগুলিকে টেকসই বলে মনে করা হয়, তারা স্থল হারাচ্ছে এবং ক্রমে বিপন্নতার পথে আগাচ্ছে। ক্রি ভাষা, ইনুক্টিটুট এবং ওজিবওয়ে হল সবচেয়ে ঘন ঘন রিপোর্ট করা আদিবাসী ভাষা। কানাডায় আদিবাসী ভাষার বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও তাদের তিনটি (ক্রি ভাষা, ইনুক্টিটুট এবং ওজিবওয়ে) জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের মাতৃভাষা হিসাবে আদিবাসী ভাষা হয়ে রয়েছে। গত ১০০ বছর ধরে আদিবাসীদের ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে, বা বিলুপ্ত করা হয়েছে. আলবার্টা, ম্যানিটোবা ছাড়া আরো ৮টি প্রদেশ ও ৩টি টেরেটরিস এর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনগণকে পর্যায়ক্রমে একুশে তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূলভাবের সাথে সম্পৃত্ত করার ধারাবাহিকতা রক্ষায় ২০১৫ থেকে কাজ করছি আমরা। ২৩ জুলাই ২০১৮ সালে কটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় কানাডায় দুই বছর আগে অপরিবর্তনীয় কিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে (বিপিসিএ) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উপর ২০১৭ একটি ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে- http://motherlanguageday.ca/); যা বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করছে।

ইনুক্টিটুট, ক্রি এবং ওজিবওয়া শুধুমাত্র তিনটি কানাডিয়ান আদিবাসী ভাষাযর যে তালিকা তা না হয় এবং বাচিয়ে রাখার আশা করা যায়, কারণ তারা এখনো মানুষের একটি সমালোচনামূলক অবস্থানে রয়েছে । আনুমানিক ৩৫,০০০ মানুষ কানাডার উত্তর জুড়ে ইনুক্টিটুট ভাষায় কথা বলতে, এবং ১১৭.০০০ ক্রি, উত্তর আমেরিকা এর সবচেয়ে উচ্চারিত আদিবাসী ভাষা বলে ধরা হয়।.তার মানে মিকম্যাক, যা ৬,৮৫০ ভাষাভাষী এবং ৩১ এর গড় বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে, একটি ভাষা যা আগামী ১০০০ বছর ও বাঁচতে পারবে না. ইউনেস্কো বিশ্বের ৬,৭০০ ভাষা এবং উপভাষা অর্ধ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে । যদি না সরকার এখনই কোনো ব্যবস্থা নিতে না বলে ।

বাংলা কি আদৌ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা? এমন প্রশ্ন এখন জোরেশোরে উঠতে শুরু করেছে। কারণ কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠতে হলে সর্বস্তরের প্রধানত শিক্ষা, প্রশাসন, আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য– সমাজ জীবনের চতুরঙ্গের একমাত্র (হ্যাঁ, একমাত্র!) ঊপকরণ ও একমাত্র ভাষা হয়ে উঠতে হবে সে ভাষাটিকে। ফ্রান্স, জার্মানি বা জাপানে যথাক্রমে ফরাসি, জার্মান ও জাপানি ভাষা উপরোক্ত চতুরঙ্গের একমাত্র ভাষা। রাষ্ট্রভাষার অধিকার ও সেখানে একচেটিয়া। এসব দেশে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। দ্বিতীয় কোনো ভাষাকে সেখানে রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়া হয় না।

বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার তালিকা ও কম দীর্ঘ নয়।যেসকল ভাষা ঝুঁকিতে আছে তা সংজ্ঞায়িত করার পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- বিলুপ্ত ভাষা Lingua Franca বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ক্রেওল: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জঙ্গলাকীর্ণ উচ্চভূমি এলাকায়, এক ডজনেরও বেশি আদিবাসীদের জন্য বাড়িতে। সেখানে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে আদিবাসীদের ৫০%; কম ৮% সম্পূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা, এবং শুধুমাত্র ২% মাধ্যমিক সমাপ্ত। শিশুদের অধিকাংশ নির্দেশাবলী বাংলা লেখা বুঝতে পারছে না। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ, হরি, বানাই, Dalui ও রাজবংশী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতির অভাবে তাদের স্থানীয় ভাষা রেখে এখন বাংলা ভাষা ব্যবহার শুরু করেছে। “পরবর্তী সময়ে, আদিবাসী ভাষা স্কুলের মধ্যে চালু করা হয়েছে কিন্তু সমর্থন শিক্ষক, প্রশিক্ষণ উপকরণ, সব কিছূ কিছু যেমন ছিল তেমনি আছে, এসব আসলে প্রত্যেক ভাষাভাসি গোষ্টীকে একটি বার্তা দেয়া প্রয়োজন, যা নাকি এখানে দেওয়া হয়নি।

ইউনেস্কোর অনুমান মতে বিশ্বের ৯৬ শতাংশের ভাষা বিশ্বের জনসংখ্যার চার শতাংশের ভাষা দ্বারা কথা বলা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে বিশ্বের ৯৬ শতাংশ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সরকারের উচিত সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার প্রসারের জন্য একটি প্রভাবশালী ভাষার ভাষাভাষীদেরকে অন্যান্য ভাষা ও আয়ত্ত করতে উৎসাহিত করায় নেতৃত্ব দেয়া এবং বিশ্বে সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে মনোযোগী হওয়া। আমাদের উচিত একটি গর্বিত জাতি হিসেবে সব ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যকে লালন ও রক্ষা করা। বাংলাভাষা সংরক্ষণ, ও ভাষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসীদের মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে ও রক্ষা করা।

শেয়ার করুন