পরিবেশ দূষণের দায়ে সাভারের ট্যানারি শিল্প বন্ধের উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

টাস্কফোর্স গঠন হবে চামড়া শিল্পের জন্য
ফাইল ছবি

পরিবেশ দূষণের দায়ে সাভারের চামড়া শিল্প কারখানা বন্ধ করতে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে শিগগিরই ট্যানারি শিল্প কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে অধিদফতর।

বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকালে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

universel cardiac hospital

এর আগে গত ২৩ আগস্ট সংসদীয় কমিটি পরিবেশ দূষণের দায়ে ট্যানারি শিল্প কারখানা বন্ধের সুপারিশ করেছিল। পরে পরিবেশ অধিদফতর থেকে তাদের চিঠি দিয়ে কারণ দর্শানো হয়। তবে ওই চিঠির জবাব সন্তোষজনক হয়নি বলে বৃহস্পতিবারের বৈঠক শেষে জানিয়েছেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।

বৈঠকের পর সাবের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, কেন বন্ধ করা হবে না এই বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা ওই নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তারা কিছু পরিকল্পনা কথা জানিয়েছেন। ওই জবাবটি আমাদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। এজন্য আমরা ট্যানারি কারখানা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছি। পরিবেশমন্ত্রী এই বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে না হলেও সিদ্ধান্তটি জানিয়ে রাখবেন। এরপর পরিবেশ অধিদফতর ট্যানারি শিল্প বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

তিনি বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ইট ক্যান্ট কন্টিনিউ। এখন যেভাবে আছে তা চলতে দেওয়া যাবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে সভাপতি বলেন, এখানে প্রায় ১২৫টি ইউনিট আছে। ২৪টি ইউনিট ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করেছে। তারা জানিয়েছে তাদের ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটি আছে। সেটা আমরা দেখবো। সেগুলো নিয়মের মধ্যে পড়লে বিবেচনা করা যেতে পারে।

পরিবেশ অধিদফতর তার বিদ্যমান আইনের অধীনে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ট্যানারি শিল্প কারখানা বন্ধ করবে বলেও তিনি জানান।

সাবের হোসেন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তারা ৭-৮ বছর ধরে যেখানে ট্যানারি শিল্প নগরী চালু করেছে অথচ পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদনটি পর্যন্ত করেনি। তারা দূষণ করেই যাচ্ছে।

তিনি জানান, নদীদূষণের দায়ে ২০২০ সালে চামড়াশিল্প নগরীকে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। তারা এর বিরুদ্ধে আপিলও করেছিল। আমরা বলেছি ওই টাকা জরিমানা হিসেবে তাদের দিতে হবে।

সংসদ সচিবালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে পরিবেশ দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমপ্লায়েন্স অর্জন না করা পর্যন্ত সাভারের চামড়া শিল্প কারখানা বন্ধ রাখার সুপারিশ বাস্তবায়ন না করায় কমিটি অসন্তোষ প্রকাশ করে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা বন্ধ করার জন্য কমিটি আবারও সুপারিশ করে।

পরিবেশ অধিদফতরের মতে, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়। যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটারের। অর্থাৎ দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিবেশে মিশছে। গত তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে গেছে।

চামড়া শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিবেশে উন্নীত করতে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় বিসিক। হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের অনীহার পরও ২০১৭ সালের এপ্রিলে সেখানে যেতে বাধ্য হতে হয়।

চামড়াশিল্প নগরীতে ১৫৫টি ট্যানারিকে জমি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করে দেওয়ার কথা বিসিকের। তারা এ জন্য একটি চীনা কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় ২০১২ সালে। তবে তারা যথাসময়ে সিইটিপি তৈরি করতে পারেনি। আবার এই সিইটিপির সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

নিজ দফতরে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ

আগামী ১ মার্চ থেকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর এবং বন বিভাগের কার্যালয়ে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক পণ্য, যেমন- প্লাস্টিকের কাপ, কাঁটা চামচ, প্লেট ইত্যাদি ব্যবহার করবে না বলে সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়। এ বিষয়ে সভাপতি বলেন, কোনও ধরনের সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক তারা ব্যবহার করবে না। এগুলো যেহেতু নিজস্ব অফিস, এখান থেকেই শুরু হোক সেটা চাই। আমরা চাইবো পরবর্তীতে এটা বড় পরিসরে চালু হবে। যেমন আমাদের লক্ষ্য আছে এটা সংসদ ভবনেও বাস্তবায়ন করার। এজন্য আমরা স্পিকারকে অনুরোধ করবো।

বায়ুর মান বিষয়ক নিয়মিত হেলথ অ্যালার্ট

বায়ুর মান বিষয়ক পরিবেশ অধিদফতর থেকে প্রতিনিয়ত হেলথ অ্যালার্ট জারির ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। এ বিষয়ে সভাপতি বলেন, আমাদের যে প্রযুক্তি আছে তাতে আজকের বায়ুর মানের পরিসংখ্যক আগামীকাল জানাতে পারি। এটা কোনও কাজে আসে না। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মনিটরিং করা এবং মানুষকে যেন বিষয়টি তাৎক্ষণিক জানাতে পারি। যার জন্য আমরা এটাকে দুই-তিন মাসের মধ্যে লাইভ করতে বলেছি। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি।

তিনি বলেন, এটা সম্ভব হলে আমরা হেলথ অ্যালার্ট দিতে পারবো। এতে মানুষ বাসা থেকে বের হবে কিনা বা কোন এলাকায় তারা যাওয়া থেকে বিরত থাকবে, এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই হেলথ অ্যালার্ট দেওয়া নেতিবাচক কিছু নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এটা হয়। এটা হলে মানুষ তার মুভমেন্টে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

জাহাজ ভাঙা শিল্প লাল ক্যাটাগরিতে

আগে জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিবেশ দূষণের দিক থেকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত থাকলেও পরে বিশেষ বিবেচনায় এটাকে কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ কমলা ক্যাটাগরিতে রাখা হয়।

সাবের হোসেন বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ ছিল আমরা এটাকে কমলা ক্যাটাগরিতে যেন বিবেচনা করি। কিন্তু আমরা এর সায়েন্টিফিক বেসিস পাইনি। আমরা মনে করি এটাকে লাল ক্যাটাগরিতেই ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। এতে ক্যানসারসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য আমরা পরিবেশ অধিদফতরকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যাচাই করে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এছাড়া নতুন যে নীতিমালা হচ্ছে সেখানেও এটাকে লাল ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এক মাসের মধ্যে ক্লিন এয়ার নীতিমালা কার্যকর হবে বলেও তিনি জানান।

বনের ৭৩৯৫ একর জমি উদ্ধার

বনের বেদখলে থাকা সাত হাজার ৩৯৫ একর জমি উদ্ধার করা হয় বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটিকে জানানো হয়েছে। কমিটি আগামী জুনের মধ্যে ১০ হাজার একর জমি উদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে বলেছে বলে কমিটির সভাপতি জানান।

উল্লেখ্য, বন বিভাগের জমির মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বেদখলে ছিল। এরমধ্যে গত বছর আগস্ট পর্যন্ত মাসে ৫ হাজার ৬৩৯ একর ভূমি উদ্ধার হয়েছিল। গত ৬ মাসে আরও প্রায় দুই হাজার একর উদ্ধার হয়েছে।

সাবের হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য পরিবেশন, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, জাফর আলম, খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন ও শাহীন চাকলাদার অংশ নেন।

শেয়ার করুন