সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদেরকে যেসব ‘আশ্বাস’ দেন জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সেগুলোর ‘বাস্তবায়ন’ তারা দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের বিষয়ে ‘সরকারের প্রতিনিধি’ হিসেবে তাঁর দেওয়া ‘আশ্বাসের’ পর পনের দিন কেটে গেলেও এর বাস্তবায়ন নেই। কেন ‘আশ্বাসের বাস্তবায়ন’ নেই, এর হিসাব তারা মেলাতে পারছেন না।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলা এখনো তুলে নেওয়া হয়নি। তাদের প্রায় আড়াইশ মুঠোফোন ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এখনো বন্ধ আছে। তাদের দাবি পূরণের বিষয়টি নিয়ে এ সময়ের মধ্যে ড. জাফর ইকবাল সংবাদমাধ্যমে কিছু লেখেননি, বলেননি। দাবি পূরণ না হওয়ায় আবারো আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন বলে তারা জানান।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ‘সরকারের প্রতিনিধি’ হিসেবে অধ্যাপক জাফর ইকবাল শাবিপ্রবির ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে তাদের দাবি পূরণের ‘আশ্বাস’ দেন। এরপর কয়েকবার তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয় শিক্ষার্থীদের। তিনি দাবি পূরণের বিষয়ে তখনো ‘আশাবাদী’ বলে তাদেরকে জানান। কিন্তু দাবিগুলো পূরণের লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় তারা আবার সরব হয়ে উঠেছেন। ৯ ফেব্রুয়ারি, বুধবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
তবে শাবিপ্রবির প্রক্টর মো. আলমগীর কবীরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইশরাত ইবনে ইসমাইলকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন মত ও পথকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘মো. আলমগীর কবীরকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে প্রক্টরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবেদীন মত ও পথকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা জাফর ইকবাল স্যারের মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসে অনশন কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলাম। বলা হয়েছিল, আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। দীর্ঘদিন পরও আমাদেরকে দেওয়া আশ্বাসগুলোর কোনোটিই বাস্তবায়নের কোনো প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
তার অভিযোগ, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর দেওয়া দুটি মামলা এখনো ঝুলে আছে। শিক্ষার্থীদের প্রায় আড়াইশ মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেগুলোও চালু করা হয়নি। আমাদের কঠোর কর্মসূচিগুলো থেকে সরে আসার পরও ন্যূনতম দাবিগুলো পূরণ করা হয়নি। এ জন্য এতোদিন পর আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছি।’
জানা যায়, গত ১৬ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচির একপর্যায়ে ১৯ জানুয়ারি থেকে একদফা দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা ২৮ হয়। ২৬ জানুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান। এরপর থেকে অহিংস আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে অবরোধ ও অনশন কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়ান শিক্ষার্থীরা। তবে আন্দোলন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চালিয়ে আসছিলেন তাঁরা। একপর্যায়ে ১৪ দিন পর বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নামেন তারা।
ড. জাফর ইকবাল সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ‘আশ্বাস’ পেয়ে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান। এরপর এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে, শাবিপ্রবির উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ‘দীর্ঘ ছুটিতে’ যেতে পারেন। ‘ছুটির কৌশলের’ মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছেড়ে দেবেন। ‘লম্বা ছুটি কৌশলের’ বদলে তিনি ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগও’ করতে পারেন। তাঁর পদত্যাগে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাঁকে এসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন।
গত ১৩ জানুয়ারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয় বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ’ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিনদফা দাবিতে। শুরুতে কয়েকশত ছাত্রী ওই আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেন। এ সময় শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে ‘আন্দোলনের গতি’ বদলে যায়।
উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের ‘একদফা দাবিতে’ রূপ নেয় আন্দোলন। এক সপ্তাহের মাথায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অনশন শুরু করে। অনশনের সাত দিনের মাথায়, বা ১৬৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদেরকে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান। এরপরও মূল দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।