বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সার্চ কমিটির বৈঠকের কোনো ফল হয়?

হাসান শান্তনু

‘অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) সঙ্গে অতীতে মতবিনিময়ের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়’- এমন অভিযোগ দেশের বিশিষ্ট কয়েক নাগরিকের। তাদের মতে, আগেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে কমিটির মতবিনিময় শেষ পর্যন্ত শুধু ‘আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ’ থাকে। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বের বিদায়ী ইসি গঠনের আগে ২০১৭ সালের সার্চ কমিটির সঙ্গে বিশিষ্টজনদের মতবিনিময় নিয়ে ওই অভিজ্ঞতা হয়।

তখন আমন্ত্রিত নাগরিকদের দেওয়া বেশ কয়েকটি পরামর্শ ওই কমিটির কাছে গুরুত্ব পায়নি বলে অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম প্রকাশের দাবি বৈঠকে কেউ কেউ জানালে তা প্রকাশের আশ্বাস দেয় কমিটি। কিন্তু কমিটি সেই কথা রাখেনি, নামগুলো প্রকাশ করেনি। সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে অন্যবারের মতো এবারো বিশিষ্টজনদের মতামত নিচ্ছে অনুসন্ধান কমিটি। এবারের মতবিনিময় ইতিবাচক কোনো ফল দেবে কী না, এ প্রশ্ন উঠেছে।

ইসি গঠনে বিশিষ্টজনদের পরামর্শ কতোটুকু গুরুত্ব পাবে বা তাদের পরামর্শ বাস্তবায়নে কমিটির স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার মতো প্রকৃত ক্ষমতা আইনে আছে কী না- বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে দেশজুড়ে। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শুরু থেকেই সার্চ কমিটির প্রতি ‘অনাগ্রহ’ আছে। দলগুলো চিঠি পেলেও ইসি গঠনে পছন্দনীয় ব্যক্তিদের নামের প্রস্তাব পাঠায়নি কমিটির কাছে।

গঠিত হওয়ার পর থেকে কার্যক্রম থেমে নেই সার্চ কমিটির। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আজ শনিবার বৈঠকে বসে কমিটি, আগামীকাল রোববারও বসবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে আসা বিশিষ্ট পেশাজীবী নাগরিকরা মত ও পথকে বলেন, এবারের সার্চ কমিটি ঘিরে আশাবাদ অনেকটাই ভিন্ন। আগের দুটি কমিটির তুলনায় এবারের কমিটির স্বাধীনভাবে সাহসী ভূমিকা রাখার সুযোগ বেশি। দলনিরপেক্ষ বিশিষ্টজনরাও একই কথা বলছেন।

তাদের মতে, এর আগে ইসি গঠনে দুইবার সার্চ কমিটি গঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে পর পঞ্চাশ বছরের মধ্য এবারই প্রথমবারের মতো আইনের মাধ্যমে এ কমিটি গঠিত হয়। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ইসি গঠনে আইন প্রণয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। সেই আইন প্রণীত হয়েছে সম্প্রতি।

তারা জানান, ইসি আইনের ৪ (১) ধারায় সার্চ কমিটিকে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন এবং যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করতে পারে। কমিটিকে আইনের ৩ (২) ধারায় তার সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ইসি গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বাছাই করতে এবারের কমিটির আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সার্চ কমিটির শনি ও রোববার কয়েক দফায় বৈঠক অনুষ্ঠান ইতিবাচক বলে মনে করেন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের’ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ‘জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী শক্তিশালী একটি ইসি গঠনে এ বৈঠক সফলতা বয়ে আনবে’ বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

জানতে চাইলে মত ও পথকে শনিবার মুঠোফোনে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সার্চ কমিটির আমন্ত্রিত অর্ধশতাধিক অতিথি রাজনীতির ঊর্ধ্বে আছেন। তারা দলনিরপেক্ষ। আলোচনা ও পরামর্শের জন্য তাদেরকে ডাকা হয়। তাদের কাছ থেকে নীতি নিরপেক্ষ একটি কমিশন গঠনের আহ্বান নিশ্চয় আসছে, বা আসবে। বিশিষ্টজনদের অভিমত এমন থাকবে, যারা সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তারা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে দৃঢ়চেতা মনোভাবের ও দুর্নীতিমুক্ত হবেন।’

তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের মতামত গুরুত্ব দিলে ও তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে নাম লিপিবদ্ধ করলে ভালো হবে। তবে এটা সবক্ষেত্রে ম্যানেজেবল নাও হতে পারে। কেননা, এখানে অনেকে ভিন্ন মতামত দেবেন। বৈঠক যেন লোক দেখানো না হয়, সে বিষয়টির ওপর গুরুত্বরোপ করতে হবে। আমরা আশাবাদী, এসব আলোচনার মধ্য থেকে সত্যিকার অর্থে আমরা যেন সুফল পেতে পারি।’

যোগাযোগ করলে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিকের’ (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শনিবার বিকেলে মত ও পথকে বলেন, ‘ইসিতে নিয়োগের জন্য সঠিক ব্যক্তিদেরকে খুঁজে বের করতে হলে সার্চ কমিটিকে লোকদেখানো ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের অনুসন্ধান পরিচালনা করতে হবে। কারণ, আবারও একটি অনুগত ইসি জাতি হিসেবে আমাদেরকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই নবগঠিত সার্চ কমিটিকে সঠিক ব্যক্তিদেরকে কমিশনে নিয়োগের জন্য বাছাই করতে হবে। আইনের ৪ (১) ধারায় উল্লেখিত স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে অনুসন্ধান করলেই তা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রসঙ্গত, দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের ৬০ জনের বেশি বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীকে আমন্ত্রণ জানায় সার্চ কমিটি। শনিবার প্রথমার্ধে প্রথম দফার বৈঠক হয় বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু হয়। আগামীকাল রোববারও আমন্ত্রিত বিশিষ্টজন ও পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করবে কমিটি। ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট ভবনের জাজেস লাউঞ্জে শনিবার অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনরা কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে।

শেয়ার করুন