ঢাকার সিনেমার গানে বসন্ত সেই কবে থেকে ঠাঁই নিচ্ছে, তা হুট করে বলে দেওয়া মুশকিল। সিনেমার গান, সংলাপ, দৃশ্যে ফাগুন বরাবরই ভিন্নমাত্রা যোগ করে আসছে। ‘আইলো দারুণ ফাগুন রে, লাগলো মনে আগুন রে’ গানে ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পাওয়ার কী ব্যাকুলতা এক তরুণীর। যা আশির ও নব্বইয়ের দশকের সিনেমার দর্শকদেরকে খুব নাড়া দেয়, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের দর্শক ও শ্রোতাদেরকে। অনেকের ঠোঁটে গানটি যেন লেগেই থাকতো। দশকের পর দশক ধরেই ঢাকার ছায়াছবির গানে থাকছে বসন্ত।
আধুনিকধারার বাংলা গানকেও বসন্ত ঋদ্ধ করছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে তাঁদের পরবর্তী কবি, গীতিকবিদের কবিতায়ও আসছে ফাল্গুন। তাদের কবিতার রূপান্তর ঘটছে গানে। আধুনিক অনেক গানে বিনোদিত হওয়ার পাশাপাশি সেগুলোর একটা সাহিত্য মূল্য আছে। গানগুলো শৈল্পিকও। বসন্তে ‘ঘুম ভাঙানিয়া মরার কোকিল পাখির’ কথাও আছে আধুনিক গানে। ইট, কাঠ, পাথরের শহরেও বাজে এ গান। এমনকি মরমি বিচ্ছেদে কাতর বাউলের গানেও ‘বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধে’ ভালোবাসার আকুতি আছে।
১৯৯৮ সালে ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘আমি সেই মেয়ে’ সিনেমার ‘ফাগুনের দিন’ গানটি বহুল জনপ্রিয়। গানটির প্রতি ভীষণ রকম ভালোবাসা আজও রয়ে গেছে অনেকের, তাদেরকে ভালোবাসার উজ্জীবনের আলোয় বাঁধে আজও। নির্ভার হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার দিনগুলো কারো কারো যেন ফিরে আসে গানটি শোনে। ভারতীয় শিল্পী কুমার শানু ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া গানটির কথাগুলো অসাধারণ। ‘ফাগুনের দিন শেষ হবে একদিন, ঝরনার সাথে গান হবে একদিন, এ পৃথিবী ছেড়ে চলো যায়, স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সীমাহীন’। রুহুল আমিন বাবুল পরিচালিত ওই সিনেমায় আলমগীর ও বলিউডের জয়া প্রদা অভিনয় করেন গানটিতে। গানটি লেখেন কলকাতার ঋতুপর্ণা ঘোষ, সুর সঙ্গীত করেন টাবুন।
ইবনে মিজানের ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’ সিনেমায় রুনা লায়লার কণ্ঠে, অঞ্জু ঘোষের অভিনীত- ‘আইলো দারুণ ফাগুন রে, লাগলো মনে আগুন রে, একা একা ভালো লাগে না’ গানটি তুমুল দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। ওই সময়ের দর্শকদের মধ্যে অনেকের কাছে আজও গানটির আবেদন কমেনি। এর প্রমাণ মেলে ইউটিউবে গানটির ভিউয়ার্সের সংখ্যার দিকে তাকালে।
ফাগুনের প্রতীক্ষাও আছে সিনেমার গানে। পশ্চিমবঙ্গের নচিকেতা ও শিখা বোসের গাওয়া ‘… আসে না ফাগুন, মনেতে আগুন, এমন বিরহ জ্বালায়, স্মৃতির মেলায়, কাটে না আর দিন, একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনার বর্ণবিহীন, এ জীবনে যেন আসে এমনই স্বপ্নের দিন’। গানটি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র। যা ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলা ভাষার প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্র হিসেবে সমাদৃত। ঢাকা-কলকাতার যৌথ প্রযোজনার এ ছবি পরিচালনা করেন বাসু চ্যাটার্জি। এতে অভিনয় করেন ফেরদৌস ও প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী।
শাবনূর, রিয়াজ, শাকিল খান অভিনীত ‘নারীর মন’ সিনেমার গানটাও দর্শকদের মাতিয়ে তোলে। ‘জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন, ও বান্ধবী অনামিকা, আজ তোমাকেই প্রয়োজন’ শিরোনামের গানটি এখনো অনেকের প্রিয়। গানটি গেয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী খালিদ হাসান মিলু। ওমর সানি-মৌসুমীর ‘হারানো প্রেম’ ছবিতে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘এলো বসন্ত আমার গানে, কোকিল বলে এসো বন্ধু হয়ে যাই’ বেশ নাড়া দেয়।
সংগীতশিল্পী এস আই টুটুল ও তরুণ কণ্ঠশিল্পী সুধা ‘বসন্ত বিকেল’ সিনেমায় ‘একটা বসন্ত বিকেল’ শিরোনামের গান একসঙ্গে গেয়েছেন। জনপ্রিয় গীতিকবি কবির বকুল এর কথায় গানটির সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন রবিন ইসলাম। ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর গানটির রেকর্ডিং হয় ঢাকার ফোকাস স্টুডিওতে। সিনেমাটি এখনো মুক্তি পায়নি।
নানা শ্রেণি-পেশার শ্রোতার কাছে বসন্তের গান মানেই যেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার, ভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে, আমি বারে বার আসি ফিরে, ডাকি তোমায় কাছে’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তপন চৌধুরীর ‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে দারুণ মাস, আমি জেনে গেছি তুমি’ গানটি আলোড়িত করে আজও।
মমতাজ ও বেবী নাজনীনের আলাদা গাওয়া ‘হিট গানগুলোর’ মধ্যে অন্যতম ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে, আমায় উদাসী বানাইলো গো মরার কোকিলে, আমায় উদাসী বানাইয়া গেল বসন্তেরই কালে’। প্রখ্যাত গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে ‘ওই ফাগুনের ঊষায়’, ‘ফাগুন এসে কড়া নাড়ে’ আর ‘বসন্ত এলো রে’ শিরোনামের তিনটি গান গেয়েছেন বিভিন্ন শিল্পী।
প্রয়াত গীতিকবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা ও ফেরদৌসির গাওয়া ‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’ গানটি একসময় বেতারের শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতো। বেতারে বেজেছে অসংখ্যবার। এটাকে বলা হয় প্রথম আধুনিক বাংলা গান। আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা ‘মহুয়ার বনে বনে মৌমাছি ওড়ে মনবিলাসে, ঝিকিমিকি রোদ লাগে পলাশে, ফুলে ফুলে গুঞ্জন, ভুলে বুঝি যায় মন, ফাগুনের আলোড়ন দোলা দেয় চঞ্চল বাতাসে’ গানটিও শ্রোতাদের খুব টানতো। যা গেয়েছিলেন শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখায় আরেকটি ফাগুনের গান গেয়েছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী- ‘মহুয়ার হাসিতে রাখালিয়া বাঁশিতে ভুলেছি আমি, পলাশের মেলাতে ফাগুনের দোলাতে দুলেছি আমি’। ওই সংগীতশিল্পীর ফাগুনমাসের আরেকটি গান বেশ জনপ্রিয় ছিল- ‘কুসুমে কাঁপে ওই ফাল্গুনী সন্ধ্যা, ঘনালো কাজলে কালো কী’নিবিড় তন্দ্রা’। যা প্রয়াত গীতিময়ী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা।