আইন প্রয়োগের শিথিলতায় বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

শামছুল হক

সড়ক দুর্ঘটনা
প্রতীকী ছবি

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, বিষয়টি আদৌ সরকারের গায়ে লেগেছে কি না। বাবার শ্রাদ্ধের কাজে যোগ দিতে গিয়ে একসঙ্গে পাঁচটা ভাই মারা গেল সড়কের পাশে। তাও এমন একটা গাড়ির চাকায় তাঁদের প্রাণ গেল, যে গাড়িটি আনফিট এবং এর চালকও আনফিট। আমার কাছে এটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার এবং ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার মতোই ঘটনা।

এটা আমাদের মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশন উত্তপ্ত হয়ে পড়ার মতো একটি ঘটনা। আমাদের মাননীয় আইন প্রণেতাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সংসদ থেকে বিবৃতি আসার মতো ঘটনা এটা। কক্সবাজারের চকরিয়ায় সংঘটিত এমন একটা হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা শুধুই একটি দুর্ঘটনা নয়, এটা আমাদের আইন প্রয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের অবহেলা, অনিচ্ছা, অনাগ্রহের সংস্কৃতিরই একটা অংশ।

আমাদের সড়ক নিরাপত্তার সমস্যাটি অনেক গভীরে প্রোথিত। হঠাৎ কোনো একটি ইস্যুতে কয়েক দিন জোরজবরদস্তি করলেই সড়ক নিরাপত্তার কাজ হয় না। এ কাজটা করতে হয় সারা বছর ধরে। এটা অত্যন্ত গতিশীল একটা ব্যাপার এবং পরিবেশটাও গতিশীল রাখতে হয়। এই কাজে ফুলস্টপ দেওয়ার সুযোগ নেই। পশ্চিমা দেশগুলো একটা পদ্ধতিগত উপায়ে মৃত্যুর এই মহামারি কমিয়ে আনতে পেরেছে। তারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিকারগুলো করে এটাকে খুবই সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে এসেছে। এটা করতে গিয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে এবং দায়িত্বশীল ইউনিটের মাধ্যমে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এটা এক দিনে হয়ে যায়নি। সাফল্য পেয়ে তারা ভুলেও যায়নি। অবস্থানটাকে ধরে রাখার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিয়ত কাজটি তারা করে যাচ্ছে। এটাই আমাদের এখানে হচ্ছে না।

বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা দেখতে পাই একজন সংবাদকর্মী তাঁর পেশাগত চোখ দিয়ে বিষয়টির একটা প্যাটার্ন দেখতে পান। একেকটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে তারা যখন আমাকে প্রশ্ন করেন, তাঁদের এই পর্যবেক্ষণটি আমার কাছে ধরা পড়ে এবং বিষয়টি আমার ভালো লাগে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, একজন সাংবাদিক বা একজন সড়ক বিশেষজ্ঞের চোখে ধরার পড়ার আগেই রাস্তাটি যাদের, তাতে গাড়ি নামানোর এখতিয়ার যাদের, তাদের কাছে এ নিয়ে আগে কোনো তথ্য থাকে না। সড়কটি নিরাপদ রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অর্পিত দায়িত্ব আছে, সেটা তাদের পালন করতে দেখা যায় না।

আমরা দেখতে পাই, কিছু জায়গা আছে ঘুরেফিরে সড়ক দুর্ঘটনা সেখানেই বেশি ঘটছে। কক্সবাজারের চকরিয়া এর অন্যতম। একই জায়গায় যদি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা নিয়মিত ঘটে, তাহলে ওই জায়গায় নিশ্চয়ই জানান দিচ্ছে, ম্যান-মেড বা মানুষের করা কিছু ভুল ওই জায়গায় হয়ে আছে। কারণ দুর্ঘটনা একটা দৈব জিনিস। রাস্তায় দৈবক্রমে পড়ে থাকা তীক্ষ কোনো বস্তুর খোঁচায় চাকা পাংকচার হয়ে যাওয়া কিংবা ব্রেক ফেল করার বিষয়টিকে দুর্ঘটনা বলা যায়। কারণ কখন, কোথায়, কিভাবে এটা ঘটবে তা আগে থেকে জানার সুযোগ নেই। কিন্তু একই জায়গায় যদি বারবার একই ঘটনা ঘটে তাহলে বোঝাই যায়, সেখানে আবারও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমনটা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের রাত-দিন একাকার হয়ে যাওয়ার কথা, ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা।

আমি এ জন্যই কথাটা বলছি যে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার আগেই সড়ক যারা বানিয়েছে, এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদেরই। যেকোনো ঘটনার পরই তারা দ্রুততম সময়ে সেফটি অডিট করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিকার করবে। আমাদের এখানে একবারের জন্যই এমনটা দেখা যায়নি।

আমাদের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০০৫ সালে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে একটি উদ্যোগ নেয়। বিদেশে কিভাবে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং কিভাবে রোড সেফটি অডিট করতে হয়, সেটা আমাদের এখানে কাজে লাগাতে অধিদপ্তর ফিনল্যান্ড সরকারের সহায়তায় একটা ম্যানুয়্যাল তৈরি করে এবং এর ওপর চার-পাঁচটি প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু ম্যানুয়ালটি তারা অনুসরণ করছে না। তার মানে রাস্তা নিরাপদ রাখার জন্য জনগণের পয়সায় প্রকল্প হলো, ট্রেনিং হলো, কিন্তু কাজে লাগানো হলো না।

অর্থনীতিতে অডিটের ব্যবস্থা এ জন্য রাখা হয় যে সেখানে কোনো ধরনের নোংরা খেলা হচ্ছে কি না, অপতৎপরতা হচ্ছে কি না, গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছে কি না, সেসব অডিটে আসা লোকজনের বিচক্ষণ চোখে ধরা পড়ে। এর উদ্দেশ্যই থাকে অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। একই জিনিস রাস্তার ক্ষেত্রেও জরুরি। পুরো পৃথিবীতেই সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাস্তা জন্ম হওয়ার আগে একটি প্রি-অডিট করা হয় এবং রাস্তা হয়ে যাওয়ার পর আরেকটি পোস্ট-অডিট করা হয়। আমাদের এখানে এই সংস্কৃতিটিই গড়ে ওঠেনি। আমাদের এখানে মানুষ মরে গিয়ে প্রমাণ করছে যে আমাদের সড়কে ব্ল্যাক স্পট আছে।

উন্নত প্রশাসনের ভাষ্যই হচ্ছে রাস্তা নির্মাণ, রাস্তায় গাড়ি নামানো ও চালানোর অনুমতি যে বা যারা দেবে, তাদেরই দায়িত্ব হচ্ছে সড়ক ত্রুটি এবং গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের শর্ত মানা হচ্ছে কি না দেখা। আমাদের এখানে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নামেন এবং মন্ত্রী পরিদর্শন করে ছবি তোলেন। এভাবে ঝটিকা আক্রমণ, মৌসুমি আক্রমণ করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বেঁচে যান। এটা নিয়মিতই ঘটছে এবং এ জন্যই সরকারের বিরাট একটা গাফিলতি আছে এখানে। জান-মাল রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান সরকার একটি ধারাবাহিক সরকার। এর কাছে সবারই প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু আমি হতাশ হই যখন দেখি যে এখনো দিকনির্দেশনা আসে। দিকনির্দেশনা তো অনেক আগে থেকেই আছে। আমাদের এখানে সুপারিশের ঘাটতি নেই, হাইকোর্টের দিকনির্দেশনারও কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের ঘাটতি হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জিজ্ঞাসা না করার ঘাটতি। এটাই সমস্যার মূল কারণ।

চকরিয়ার ঘটনায় দেখা গেল গাড়ির ফিটনেস নেই, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, কিন্তু এটা ধরার জন্য যে ধরনের এনফোর্সমেন্ট থাকা দরকার, প্রকৃতপক্ষে সেটা নেই। সেখানে বিআরটিএর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি, পুলিশের কোনো ভূমিকাও দেখা যায়নি। অথচ এটা দেখার বড় দায়িত্বটা পুলিশের। আমাদের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়বে, রাস্তার সংখ্যা বাড়ছে। এর বিপরীতে এই মানের এনফোর্সমেন্ট যদি চলতে থাকে, তাহলে সড়কে রক্তক্ষরণের উন্নয়ন হবে এবং এটার দায়ও সরকার এড়াতে পারে না।

এখন আমরা একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যদি চালককে দিই, এটা হবে উপসর্গের চিকিৎসা। এটা একটা তামাশা হবে। আসলে সুনির্দিষ্টভাবে আমরা জানি না কিভাবে রোগের চিকিৎসা করতে হয়, আমরা শুধুই উপসর্গের চিকিৎসা করছি, মূল রোগের নয়। মূলত আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে ওপরের স্তরে। ওপরের দিকে যাঁরা যে দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, সেই দায়িত্ব অবহেলার জন্যই এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো ঘটছে। মানুষ মরছে। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানেও আসতে পারে না। ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে, পুলিশের সরবরাহ করা ডাটা দিয়ে আমরা মহান সংসদে আত্মতুষ্টি লাভ করছি, এটা কিন্তু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সমস্যাটা জাতীয় সমস্যা এবং সামনে আরো বাড়বে।

এখন পরিস্থিতি এমন হয় যে রাস্তার মধ্যে নামলেই এখন সবাই দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে। আমাদের রাস্তা এখন দোয়া-দরুদের রাস্তা হয়ে গেছে। এটা হওয়ার কথা একটা আস্থার জায়গা, নিরাপদ বাহনের জায়গা। অথচ সেটা হয়ে গেছে দোয়া-দরুদের জায়গা। এখন পরিবারসহ কোথাও যেতে চাইলে এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে চলে আসে যে আমরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারি।

চকরিয়ায় কেন বেশি দুর্ঘটনা ঘটে? বিষয়টি জানতে ওখানে আমি তিনবার গেছি। ওই জায়গার সমস্যা হচ্ছে, সেখানে প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় পরিবারের অন্য সদস্যরা মাইক্রোবাস কিনে রাস্তায় নামান। আর সেটা বাণিজ্যিকভাবেই চালানো হয়। সেখানে মাইক্রোবাস ভর্তি করে যাত্রী বহন করা হয়। ভালো মানের গণপরিবহন নেই, দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়া। এগুলোর চালকরা গাড়িগুলো বাণিজ্যিকভাবে চালান কোনো ধরনের ইনস্টিটিউশনাল শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই। ফলে চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার একটা কারণ।

মূলকথা হচ্ছে, আমাদের সড়ক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেটা জাতির স্বার্থেই করতে হবে। সরকারকে এই জায়গায় আমূল একটা পরিবর্তন আনার সদিচ্ছা দেখাতে হবে।

লেখক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক

শেয়ার করুন