‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের’ চাপে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত অধ্যায়। দাবি আদায়ে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থীর প্রাণ দেওয়ার ঘটনাগুলো ভুলতে বসেছেন অনেকে। গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি, দমননীতি বন্ধ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেদিনের সফল আন্দোলনের কথা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে ভালোবাসা দিবস উদযাপন শুরু হলে দিনে দিনে তা খুব ব্যাপকতা পায়। দিবসটির ডামাডোল ও এর সঙ্গে যুক্ত পুুঁজিবাদের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে অধিকার আদায়ে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ছাত্রদের গৌরবময় ইতিহাস।
১৪ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন দেশে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে উদযাপন হয়। এ দেশেও বেশ কয়েক বছর ধরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন হয় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বিশ্বায়নের যুগে এমন একটি দিবসে উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা থেকে তরুণ প্রজন্মকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। অকৃত্রিম ও গভীর ভালোবাসা প্রকাশের একটি দিবস থাকা মন্দ কিছুও নয়। তবে আশির দশকের ১৪ ফেব্রুয়ারির নিজস্ব ইতিহাস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের গর্জে ওঠার কথা ভুলতে বসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক ছাত্রনেতারা। ভালোবাসা দিবস দেশে উদযাপন শুরু হয় ১৯৯৩ সাল থেকে। প্রবীণ সাংবাদিক, যায়যায়দিন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও উপস্থাপক শফিক রেহমান দেশে দিবসটির প্রবর্তক।
জানা যায়, ১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদের সরকারের আমলে ড. মজিদ খানের ঘোষিত বৈষম্যের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হন তারা। তখনকার প্রগতিশীল ১১টি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। সবার দাবি- ওই গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি, দমননীতি বন্ধ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির দিন।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ওই সমাবেশ ডাকে। আকাশকাঁপানো স্লোগানে নেমে আসেন তারা রাজপথে। পুলিশ গুলি করলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। হতাহতের সংখ্যার বিষয়ে তখন সরকারিভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। সেদিন দীপালি সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব আর কাঞ্চনসহ মোট কতো শিক্ষার্থী প্রাণ দেন, এ বিষয়ে প্রকৃত সংখ্যা জানতে পরবর্তী কোনো সরকারের আমলে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অনেকের নাম আজও তাই অজানা রয়ে গেছে।
১১টি ছাত্রসংগঠনের ১১০ ছাত্রনেতার কঠিন নজরদারিতে সেদিন সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় মিছিল হয়। যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলা একাডেমি, ঢাবির পুষ্টি ভবন পেরিয়ে দোয়েল চত্বর পৌঁছাতেই কার্জন হল সায়েন্স এনেক্স থেকে আরো শিক্ষার্থী যোগ দেন সেই মিছিলে। কার্জন হল আর শিশু একাডেমির মাঝামাঝি রাস্তায় মিছিল গণমিছিলের রূপ নেয়। মিছিলটি শিক্ষা ভবনের কাছাকাছি যায়। শিক্ষা ভবন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত তখন ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড ছিল। এলাকাজুড়ে শত শত দাঙ্গা পুলিশ আর সাঁজোয়া গাড়ির বহর ছিল।
১৪ ফেব্রুয়ারি ও পরের দিনও পুলিশ আন্দোলনে জড়িত অন্যদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। সেদিন অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন সাবেক ছাত্রনেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশতাক হোসেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেন, ‘সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫০ জন নিহত হন। দুজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাকি মৃতদেহগুলো গুম করে ফেলে। খোঁজাখুঁজি করেও স্বজনরা মরদেহের খোঁজ পাননি।’
তিনি বলেন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাবির বটতলায় নানা প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দেন। মিছিলের সামনেই ছিলেন মেয়েরা। শান্তিপূর্ণ মিছিল কার্জন হলের সামনে পৌঁছালে পুলিশ-বিডিআর মিলে ব্যারিকেড দেয়। তোপখানা সড়কে সেদিন ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। শিক্ষার্থীরা সেখানে বসে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে পুলিশ কোনোরকম উস্কানি ছাড়া তাদের উপর হামলা করে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ আর বেয়নেট চার্জ শুরু করে।’
সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, অনেক মৃতদেহ পুলিশ ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু জয়নাল নামের একজন ছাত্রকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেই মৃতদেহ বটতলায় নিয়ে এসে আমরা বিক্ষোভ করি। জয়নাল ছাড়া পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহা নামের একটি ছোট বাচ্চাসহ অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের পরে আর কোন খোঁজ মেলেনি।’